নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 06/09/2018
ঢাকা শহরে কত মানুষের স্থায়ীভাবে বসবাস আর আনাগোনা তার সঠিক হিসেব কেউ না দিতে পারলেও আমাদের মহানগরী এখন একটা জনঅরণ্য তাতে কারও সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। আসলেই যেন আমাদের এই নগরী মানুষের অরণ্য। নগরীর আনাচে কানাচে মানুষ গিজ গিজ করে। জীবন আর জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বন্যার পানির মানুষ ঢাকা শহরে এসে ঢুকছে প্রতিদিন। এর কারণ কী? আমাদের কেউ কী একবারের জন্যেও ভেবে দেখেছি? কোনো জরিপ বা পরিসংখ্যান কী আছে এর প্রতিকারের জন্য একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা করার জন্য?
নানাবিধ কারণে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ রাজধানী ঢাকা বা বড় শহরমুখী হন। পুরোপুরি গবেষণা ছাড়া সবগুলো কারণ বলা সম্ভব না হলেও অভিজ্ঞতা থেকে মোটা দাগে কিছু আন্দাজ করা যায়। এর মধ্যে দারিদ্র, সারা বছর কাজের অভাব, নদী ভাঙ্গনে বাস্তুহারা হওয়া, কৃষি উৎপাদনের নূন্যতম ন্যায্য মূল্য না পেয়ে অবিরাম লোকসান গোনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঋণগ্রস্ত হয়ে উচ্চ হারে সুদে টাকা নিয়ে ঋণের জালে আটকে যাওয়া, উন্নত জীবনের জন্য ভালো চাকরীর আশা, সন্তানদের নগরীর ভালো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়া, যোগাযোগ তথা পরিবহন ব্যবস্থার বেহাল দশা, ইত্যাদি।
আমরা যারা ঢাকা তথা বড় বড় শহরে থাকি তারা লক্ষ্য করে থাকতে পারি যে, সবখানেই প্রায় দেশের দরিদ্র অঞ্চল আর উত্তরাঞ্চলের মানুষেরা বেশিরভাগ শহরে রিক্সা চালিয়ে বা শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কারণ তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় সাংবাৎসরিক কাজের অভাব,আর মজুরীর পরিমাণও কম যা দিয়ে দুমুঠো অন্ন সংস্থান হয় না।
নদীবহুল এই বাংলায় সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি জমিজমা হারিয়ে নি:স্ব হয়ে কাজের সন্ধান করার জন্যেও বহু মানুষ শহরে আসে। শহরের বস্তিগুলোর দিকে একটু নজর দিলেই এ কথার সত্যতা পাওয়া যাবে। এখানে আসে মেয়েরা বাসাবাড়ি, গার্মেন্টসে কাজ করেন। পুরুষেরা কাজ করেন বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক হিসেবে বা রিক্সা চালিয়ে, কখনোবা খুব ছোট চাকরি করে।
আমরা সারা বছর পত্রপত্রিকায় দেখি যে, কোথাও দুগ্ধ খামারিরা ন্যায্য দামের অভাবে রাস্তায় দুধ ঢেলে ফেলে প্রতিবাদ করেন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, পাটে আগুন লাগিয়ে দেন ক্ষোভে দুঃখে উৎপাদন খরচ না পেয়ে। সরকার ধান চাল সংগ্রহের জন্য যে দাম আর ধান বা সরকারি গুদামে বিক্রি করতে ধান, চালে আর্দ্রতার পরিমাণের যে প্যাচ লাগান তাতে আইন থাকলেও চাষিরা আর নিজেরা ধান চাউল সরকারী গুদামে বিক্রি করতে পারেন না, পারেন বড় চাষিরা বা তাঁদের নামে অন্যরা মানে ফড়িয়ারা লাইন করে, সরকারের ধান চাল সংগ্রহের জন্য নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিদের সাথে যোগসাজশে। এটা নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ যা বাস্তব শুধু নয় চরম বাস্তব। কৃষকের নিজেদের শ্রমের মূল্য আর জমির লীজ খরচ ধরলে বেশীরভাগ কৃষি উৎপাদনে পুরা লোকসান। কারণ সরকারের কৃষিতে দেওয়া ভর্তুকির অধিকাংশই যায় স্থানীয় আমলা আর তাঁদের দোসরদের পকেটে। প্রকৃতি বিরূপ না হলে, খুব ভালো চাষি হলে আর বীজ বিক্রেতা সৎ হলে লাভ হয় বড় জোর শতকরা ১০/১৫ ভাগ। তা দিয়ে নিজেদের সংসারই চলে না তো ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাবে কীভাবে? বাধ্য হয়েই অনেকে কিছু জমি বিক্রি করে শহরে আসে ছোটখাটো ব্যবসার জন্য। শহর হয় ভারাক্রান্ত। উন্নত দেশগুলোর মতো কৃষকদের ভর্তুকির ব্যবস্থা আর তা তাঁদের প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিলে গ্রামের মানুষ আর ঢাকায় আসবেন না দলে দলে। ওরা খুব অল্পেই খুশি থাকবেন। গ্রামে তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম। বিভিন্ন শিল্প কারখানায় সরকার যে পরিমাণ ভর্তুকি বা ইনসেন্টিভ দেয়, তার চেয়ে অনেক কম টাকা কৃষকদের ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ করে তা কৃষকদের হাতে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দিলেই গ্রাম থেকে সাধারণ কৃষক আর তার ছেলেমেয়েদের শহরে আসা অনেকাংশেই কমে যাবে। শুধু ভালো লেখাপড়া আর উন্নত চাকরীর জন্য ছাড়া পারতো পক্ষে গ্রামের মানুষ ঢাকায় আসবে না। উন্নত দেশে ভর্তুকির নামে কৃষকরা সব চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা পান। জাপান, আমেরিকার মতো দেশে কৃষকরা আর তাঁদের সংগঠন অনেক বেশী শক্তিশালী। কারণ তারা সবার মুখের অন্ন যোগাড় করে দেন।
মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ নামের দানবে দেশের হতদরিদ্র মানুষদের করেছে আরও নিঃস্ব, অসহায়, দিয়েছে বংশ পরম্পরায় পুষ্টিহীনতার অভিশাপ। ব্যতিক্রম ছাড়া, যা জন্ম জন্মান্তরে চলতে থাকে। খুব যত্নবান হলেও তা থাকে কম করে হলেও তিন পুরুষ। তাই তো সরকার সারাদেশে গরীব আর গর্ভবতী মহিলা ও শিশুদের কল্যাণে অনেক প্রকল্প চালু রেখেছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা কীভাবে আবারো নানাভাবে ঋণে জড়িয়ে পড়েন তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাতে পারে। মনে করি একজন খুব গরীব কৃষক তার বাৎসরিক আয় হয় ২০ হাজার টাকা তার ১ বিঘা জমি থেকে। আবহাওয়াজনিত কারণে তার জমিতে ফলন হলো অর্ধেক তাই ১০ হাজার টাকা খুব কম সুদে ক্ষুদ্রঋণ নিলেন। সূদের হার মনে করি ১৫%, বাস্তবে হয়তো আসলে তার চেয়েও বেশী। যদি সব কিছুই ভালো থাকে তাহলেও পরের বছর ঐ খুব গরীব কৃষককে আর উৎপাদন বাড়াতে হবে ২০ হাজার+ ঘাটতির জন্য ঋণের ১০ হাজার প্লাস ১৫% সুদ সমান ফসল ফলাতে হবে। মানে কী দাঁড়ালো! একবারে কৃষি উৎপাদন এত বাড়ানো কি সম্ভব? কোনো কৃষিবিদ কি তা পারবেন? কোন ভাবেই সম্ভব নয়, তাই আরেকটা ঋণ নিয়ে ঐ ঋণ শুধতে হয়, জড়িয়ে পড়ে ঋণের জালে। ফলে একসময় যায় পালিয়ে শহরে সব সম্পদ বেঁচে দিয়ে।
আমাদের দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই খারাপ যে, ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে লাগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি। তাই উন্নত দেশগুলোর মতো মহানগরীর পাশে উন্নত সুবিধার স্যাটেলাইট সিটি বা শহর গড়ে না ওঠার ফলে সবাই থাকতে আসেন শহরে। সরকার যদি ঢাকার পশ্চিমের মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ থেকে মাওয়ার কাছাকাছি পর্যন্ত একটা শাটল ট্রেনের লাইন, আর রামপুরার পশ্চিমপাশ থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত আরেকটি শাটল ট্রেনের লাইন বা নরসিংদী অভিমুখে আরেকটি ট্রেনের লাইন করেন। আর সাভার থেকে টঙ্গী হয়ে পাটুরিয়া পর্যন্ত আরেকটি শাটল ট্রেনের লাইন বসানো হয় তখন আর মানুষ ঢাকায় থাকতে চাইবে না। কম খরচে থাকবেন দূরে যেমনটি থাকে উন্নত দেশের চাকুরে মানুষেরা।
আশে পাশের উন্নত দেশের বহু মানুষ ১০০/১৫০ কিলোমিটার দূর থেকে শহরে চাকরী করতে এসে শহরকে জনারণ্য হতে রক্ষা করবে। স্বল্প বেতনে যারা চাকরী করেন, তারা কম খরচে ঢাকার বাইরে স্যাটেলাইট সিটিতে থাকবেন। সুন্দর জীবন যাপন করবেন। শরের চাপ কমলে দেশও বাঁচবে, দেশের গরীব মানুষের কল্যাণ হবে, গড়ে উঠবে কল্যাণ রাষ্ট্র। আমরা কী এমন কোন পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরসহ বড় বড় নগরীকে জনারণ্য থেকে বাঁচানোর, উপায় খুঁজতে পারি না! তাই নগর পরিকল্পনাবিদদের বলি একটু ভাবুন, আমাদের ঢাকাসহ বড় বড় নগরীকে বাঁচান।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট
বাংলা ইনসাইডার
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭