ইনসাইড থট

ঢাকা ওয়াসার তুঘলকি!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/09/2018


Thumbnail

নানা দুর্যোগের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের নানাবিধ দুর্যোগের সাথে বন্যাজনিত দুর্যোগের মোকাবিলাও করতে হয় প্রায় প্রতি বছর। তখন বন্যা কবলিত এলাকায় বন্যার সময় আর বন্যা পরবর্তী সময়ে শুরু হয় নিরাপদ পানির অভাব। নিরাপদ পানি না পাওয়া গেলে, নানা রোগ জীবাণু ছড়ায় অনিরাপদ পানির মাধ্যমে। তাই নিরাপদ পানির জন্য দুনিয়াজুড়ে চলছে আন্দোলন, সংগ্রাম। নিরাপদ পানি ছাড়া সুস্থ জীবন কল্পনা করা অসম্ভব। এটা শুধু গ্রামে নয় শহরেও অনিরাপদ পানির মরণ ছোবল ইদানিং এমন রূপ ধারণ করেছে যে বড় বড় নগরবাসীগণ যেন সাংবাৎসরিক বন্যা কবলিত হয়ে আছেন। নগরীর কোথাও নূন্যতম নিরাপদ পানি আছে আবার কোথাও নেই, মানে আছে আবার নেই।

অনিরাপদ পানির কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭ কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতবছর ২২ মার্চ ২০১৭ তারিখ সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এ তথ্য জানানো হয়।

পানিবাহিত রোগের মধ্যে আছে আর্সেনিক দুষন জনিত রোগ। পানিতে মিশে থাকা অতিমাত্রায় আর্সেনিকের কারণে এই রোগ দেখা দেয়। ত্বকের, হৃদপিন্ডের, লিভার এবং কিডনির সমস্যা এই আর্সেনিক দুষন বা আর্সেনিকোসিস থেকে হতে পারে। কৃমির আক্রমণ একটি প্রধান পানিবাহিত রোগ। ডায়ারিয়া আর কলেরা একটি পানিবাহিত মারাত্মক রোগ। অনিরাপদ পানিতে মিশে থাকা জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটেজোয়া) কারনে ডায়রিয়া হয়ে থাকে।

জন্ডিসও পানিবাহিত রোগ। এটি লিভারকে নষ্ট করে ফেলতে পারে। জন্ডিসের ফলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া পলিও, টাইফয়েড পানিবাহিত রোগ। সলমনেলা টাইফি এবং প্যারাটাইফি নামক পানিবাহিত জীবাণু দিয়ে এই রোগটি হয়ে থাকে। ত্বকের খোস পাচড়া পানিবাহিত রোগ। দুষিত পানির সংস্পর্শে খোস পাচড়া, চুলকানিসহ নানান ত্বকের রোগ হয়। এগুলি ছাড়াও পরোক্ষ ভাবে আরো কিছু রোগের জন্য পানি দায়ী যেমন ডেংগু, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি।

সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর যাকে আমরা ডিপিএইচই বলি তারা আদতে গ্রামের মানুষের জনস্বাস্থ্যের প্রধান উপাদান পানি নিয়ে বেশি কাজ করেন। বড় বড় নগরীতে আছে ওয়াসা। যেমন ঢাকা ওয়াসা, চট্টগ্রাম ওয়াসা, খুলনা ওয়াসা, ইত্যাদি।   

পত্রিকায় গত জুলাই মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাতে বলা হয়েছে যে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সোয়া তিন লাখ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। রোগীদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শিশু। তাদের মধ্যে ৯০ হাজারের বেশি ডায়রিয়ার রোগী ঢাকার আইসিডিডিআর’বি হাসপাতালে ভর্তি হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন, অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কলেরা। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে, এমন অন্তত ২০ শতাংশ রোগী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দুই বছর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬৯টি দেশে প্রতিবছর ২৯ মিলিয়ন মানুষ কলেরার কবলে পড়ে। তাদের মধ্যে বছরে অন্তত এক লাখ রোগী মারা যায়। কলেরাও পানিবাহিত রোগ।

অন্যদিকে ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে টাইফয়েডে আক্রান্তরা ভিড় করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাবারের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমিত হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করায় রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে— এমন এলাকায় টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিবছর দুই কোটি ২০ লাখ লোক টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মারা যায় দুই লাখ ২০ হাজার।

২০১৭ সালের এক জরীপে বলা হছে ঢাকা শহরে দিনে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন লিটার পানির দরকার। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন থেকে ২ বিলিয়ন পানি। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ পানি তোলা হয় গভীর নলকূপ থেকে আর বাকীটা সরবরাহ করা হয় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা থেকে, যা ঢাকা ওয়াসার পাঁচটি শোধনাগারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানির ঘাটতি একটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ কেউ এটাকে পাতানো খেলা নামে অভিহিত করেন। পানির ঘাটতি থাকলে গাড়ি বোঝাই পানি বিক্রি হবে অলিখিত বেশি দামে, সঙ্গে আছে বকসিসের নামে জবরদস্তি চাঁদাবাজি। এলাকাবসী চাঁদা তুলে বা অন্য কোনো উপায়ে জমি দেবে আর সেখানে বসবে পাম্প, নতুন পাম্প,সেখানেই ওয়াসার আগ্রহ অনেক বেশি।

নতুন পাম্প বসানো এলাকায় কিছুদিন পানির দূষণ মাত্রা সহনীয় থাকলেও দিন বাড়ার সাথে সাথে পানিদূষণ মাত্রা বাড়তে থাকে। এর কারণ হিসেবে অভিযোগ করা হয় যে, রক্ষানাবেক্ষনের টাকায় শুধু ভিআইপি এলাকায় কাজ হয় বাস্তবে, বাকী সব এলাকায় হয় কাগজ কলমে। তা না হলে পানির ওভারহেড ট্যাংক পরিষ্কার থাকার পরেও প্রায় লাল রঙয়ের পানি আসে বাসায় পানির কল খুললে। যাতে আছে চরম দুর্গন্ধ, কোনো মানুষ সেই পানি কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবেন না। আবার আপাতঃ দৃষ্টিতে পরিষ্কার মনে হলেও সেই সব পানি যে দূষিত তা নানাভাবেই নানাজনে প্রমাণ করেছেন। ঢাকা শহরের ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর যে হিসেব উপরে দিয়েছি তাতেই বুঝা যাবে ঢাকা ওয়াসার পানির কোয়ালিটি নিয়ে।

ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র মতে প্রধানতঃ দুইভাবে ওয়াসার কোয়ালিটি নষ্ট বা দূষিত হয়। এক শোধনের সময় শোধনকারী উপাদানে ফাঁকি দেওয়া বা চুরি করা, আর দ্বিতীয়ত পানি সরবরাহ লাইনের ত্রুটির কারণে। এই ত্রুটি আবার দুইভাবে হয়। এক লাইন বসানোর সময় বাজে কোয়ালিটির পাইপ দিয়ে লাইন বসানোয় ফলে দ্রুত তা নষ্ট হয়ে যায়, যার মেরামতের বরাদ্দ থাকে না। কারণ লাইন বসানোর সময় বলা থাকে যে এই লাইন এত বছর রক্ষণাবেক্ষন ছাড়াই চলবে। কিন্তু বাস্তবে তা চলে না বলেই পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্যুয়েরেজের ময়লা দূষিত পদার্থ এসে পানিকে অনিরাপদ আর ব্যবহার অযোগ্য করে তোলে। দ্বিতীয়তঃ বস্তিগুলোতে অবৈধ পানির লাইন দেয় ওয়াসার কিছু অসৎ কর্মী। ৫/১০ টা অবৈধ লাইন দেয় ওয়াসার কর্মীরা মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে। তা দেখে বস্তির তথাকথিত অশিক্ষিতরা লাইন দেওয়ার কৌশলটা শিখে যায়। তারা রাতের অন্ধকারে শত শত লাইন নিয়ে নেয় হয়তো ১০০ মিটার মেইন পাইপ থেকে। এতে মূল পানি সরবরাহ পাইপও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পানি দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে হ্যাঁ, বস্তির অবৈধ লাইন থেকে মাসে মাসে মাসোহারা পেতে ওয়াসার কর্মীরা কষ্ট পান না। তাই তো সিস্টেম লস কমে না বাড়ে, যদি সুযোগ পায়।              

মোহাম্মদপুরে বৌ বাচ্চা নিয়ে বাস করেন আমার এক সদ্য পুরাতন সহকর্মী। তিনি বা তার দপ্তর ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ওয়াসাকে নিরাপদ পানি সরবরাহে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করছে বা করছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ওয়াসার অনেক মজার মজার রিপোর্ট জমা আছে যা দেখলে মনে হবে স্বর্গ থেকে দেবদূত এসেছেন নগরীর জনগণকে পানির পরিসেবা দিতে। ২/৩ দিন আগে তিনি তার বাচ্চাকে গোসল করাতে গিয়ে হতবাক। লাল আয়রনযুক্ত দুর্গন্ধ পানি। উনি খুব আপসেট হলেও মাথা ঠান্ডা করেই খোঁজ নিলেন যে বাসার ওভারহেড ট্যাংক পরিষ্কার আছে কী না। দেখলেন বাসার ওভারহেড ট্যাংক পরিষ্কার, আর তখনই উনার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। উনি ফেসবুকে পানির ভিডিও সহ ছবি পোস্ট দিয়ে আক্ষেপ করে অনেক কথাই বললেন। বলার কারণ আছে উনার। উনি বছরে বহু টাকা আয়কর দেন, দেশের জন্য, উন্নয়নের জন্য। তাই তার আক্ষেপের সূত্র ধরে অনেকেই অনেক কথা বলার সুযোগ পেলেন। তাই ধান ভানতে শীবের গীত গেতে দোষের কী! একটা ছড়ার লাইন মনে পড়ে গেলো। এটা ওয়াসার লোকদের জন্য। কারণ সরকারি আমলাদের বিরুদ্ধে কারও কিছুই বলার নেই এক প্রধানমন্ত্রী ছাড়া। কারণ ‘সচিবালয় নির্দেশমালা ২০১৪ আর ‘Rules of Business 1996 (Revised up to July 2012) page 3 (v)’ একটু চোখ বুলালে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা বুঝতে পারবো আমরা। তখন আর তাঁদের গালি না দিয়ে গালিটা যাবে অন্য দিকে। দূষিত পানি নিয়ে তখন হয়তো আমাদের একটা ভরসা হতে পারে আদালত। তাই ওয়াসার তুঘলকি ধরে যদি এমন হয়:   

‘চুরি ধরা পড়লে পরে

কোর্টে দিলো অর্ডার করে,

তোমার পোলা তোমার নাতি

এটাই খাবে দিবা রাতি।

তখন বেটা বুঝবে মজা

মিথ্যা টাকার জন্য বাঁচা।

 

লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

তথ্যঋণ: বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, আনিসুজ্জামান চৌধুরী



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭