ইনসাইড আর্টিকেল

‘খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নাই’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/09/2018


Thumbnail

ফলমূল-শাকসবজি সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিতে ফরমালিন কোনো ভূমিকা রাখেনা। ফলমূলকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ফরমালিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নাই। কেউ যদি ব্যবহার করেও থাকে তাতে কোন লাভ হবে না। কোনো বস্তুকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে সেই বস্তুকে ফরমালিনের দ্রবণের মধ্যে দীর্ঘ সময় ডুবিয়ে রাখতে হয়। ফরমালিনের দ্রবণের মধ্যে শুধু একবার চুবিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠিয়ে ফেললেও কাজ হবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফরমালিন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অহেতুক আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নাই।’ 

সুস্থ থাকতে হলে খাবারের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে খাবার নিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। ফুটপাথ থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্টুরেন্ট সবখানেই ভেজাল। কিছুদিন আগে ভেজাল বিরোধী অভিযানে নামীদামী প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকেই করা হয়েছে জরিমানা। ট্রাকের পর ট্রাক আম ও বিভিন্ন ফলমূল ধ্বংস করা হয়েছে। খাবার নিয়ে মানুষের এই আতঙ্কের বিষয়টি লক্ষ্য করে বাংলা ইনসাইডার মুখোমুখি হয় ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হকের। উপরোক্ত কথাগুলো তিনিই বলেন। বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের জন্য তাঁর সাক্ষাতকারটি দেওয়া হলো:

বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য এবং ফলমূল, শাক-সবজিতে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। এই বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বক্তব্য কি?

ইতিপূর্বে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল প্রসঙ্গে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর সবগুলোই যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে বিষয়টি এমন ঘটেনি। এইসব প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য খাদ্য বিষয়ে মানুষের অন্ধ বিশ্বাস প্রচলিত ধ্যান ধারণা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন আমরা কথায় কথায় বলি, ফলমূল, শাক-সবজিতে ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলা হয়েছে, ফরমালিন বা ফরমালডিহাইড একটি উদবায়ু বস্তু, যা বাতাসে উড়ে যায়। প্রোটিন ছাড়া অন্য কিছুর উপর ফরমালিনের তারতম্য ঘটে না। ফলমূল শাকসবজিতে যদি ফরমালিন দিয়েও দেওয়া হয় তাতেও কোন কাজ হবেনা যেহেতু সেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি নেই।  

বিআরসি (বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের) এক গবেষণায় ফলমূল-শাকসবজিতে ফরমালিন প্রয়োগ করে দেখা যায়, ফলমুল-শাকসবজি সংরক্ষনকাল বৃদ্ধিতে ফরমালিন কোনো ভূমিকা রাখেনা। ফলমূল বা ফসলকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ফরমালিন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নাই। কেউ যদি ব্যবহার করেও থাকে তাতে কোনো লাভ হবে না। কোনো বস্তুকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে সেই বস্তুকে ফরমালিনের দ্রবণের মধ্যে দীর্ঘ সময় ডুবিয়ে রাখতে হয়। ফরমালিনের দ্রবণের মধ্যে শুধু একবার চুবিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই উঠিয়ে ফেললেও কাজ করবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফরমালিন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অহেতুক আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নাই। বিভিন্ন গবেষণা ও আমাদের নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, মাছ, মাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মেশানোর কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ফরমালিন থাকে। সেই ন্যাচারাল ফরমালিন আমরা নিরাপদে যে মাত্রায় গ্রহণ করতে পারি, আমরা দৈনিক খাদ্যভাস অনুযায়ী যে খাবার খাচ্ছি তাতে যে ফরমালিন থাকে তা নিরাপদ মাত্রার মধ্যেই আছে। 

ফলমূল, শাকসবজি উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়, এগুলো মানব স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর?    

ফলমূল, শাকসবজি ও কৃষিজ পণ্যে রাসায়নিক সার ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের প্রয়োগের কারণে, মাটি বা বায়ু দুষিত হওয়ার কারণে যে দূষণ হচ্ছে, সেগুলো কিছুটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছে। পোলট্রি বা বা ডেইরিতে দেখা যাচ্ছে যে, এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ-হরমোন, পশুর রোগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ঔষধ, ব্যবহার করার পর একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার আগেই বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে এ বিষয়গুলোতে কিছুটা সমস্যা আছে। এই বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছি, কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেলেও, তা মাত্রাতিরিক্ত না। তাই এখানেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। 

ফলমূল পাকানোর জন্য যে ইথোফেন ব্যবহার করা হয় এতে কি কোনো সমস্যা হয়? 

অতীতে পরীক্ষা করে ট্রাকের পর ট্রাক আম নষ্ট করা হয়েছে। এবছরও আমার সিজনেও আমরা দেখেছি, কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর দায়ে বলা হচ্ছে ইথোফেন ফরমালিনের চেয়ে ক্ষতিকর। অথচ ইথোফেন বিশ্বব্যাপী নিরাপদ ফল পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশের আইনেও ইথোফেন ব্যবহার বৈধ। তবে তা নির্দিষ্ট পরিমাণে এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ব্যবহার করা উচিৎ। তাহলেই ফলমূলে নিরাপদের ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হয় না। এটাও ঠিক যে অপরিপক্ব ফল পাকানোর ফলে, ফলের যে স্বাদ ও পুষ্টিগুণ তা থাকে না। তবে স্বাস্থ্যহানি বা ক্ষতির কোনো কারণ নেই।

বিভিন্ন ফলমূলের মধ্যে যেমন তরমুজ, পেঁপেতে রং দেওয়ার কথা শোনা যায় এগুলোর সত্যতা কতটুকু?

তরমুজ ও অন্যান্য ফলে রং মেশানোর বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহায়তায় আমরা একটি গবেষণা করেছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০টি তরমুজ সংগ্রহ করে তাঁরা পরীক্ষা করেছে। পরীক্ষায় রং মেশানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। অধিকন্তু তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিমভাবে তরমুজে বাইরে থেকে রং ঢুকানোর কোনো সুযোগ নাই। তরমুজ একটা ইনট্যাক্ট টাইড ফল বাইরে থেকে কোনো জিনিষ ঢুকানো সম্ভব নয়। আমরা নিজেরাও এটা পরীক্ষা করে দেখেছি, সুতরাং এটা নিতান্তই অমূলক অসত্য একটা বিষয়।  

প্যাকেটজাত বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটের গায়ে যেসব উপাদানের কথা যে পরিমাণে লেখা থাকে, বাস্তবে দেখা যায় সেই খাবারে সেগুলো থাকে না। এ ক্ষেত্রে আপনাদের কোনো কার্যক্রম আছে কি?

আমাদের একটি প্রবিধানমালা আছে। যেটাকে মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেভেলিং প্রবিধানমালা বলে। প্যাকেটজাত যেসব খাদ্য আছে, তাঁর গায়ে কি কি লেখা যাবে, কি কি লেখা যাবে না, সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ খাদ্যদ্রব্যের গায়ে অপর্যাপ্ত তথ্য থাকে। কোনো খাদ্যদ্রব্যে এলার্জেন কোনো কিছু আছে কি না তা উল্লেখ করতে হবে। প্যাকেটের খাবারে কি কি সংযোজন করা হয়েছে তাও উল্লেখ করতে হবে। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

কি উপায়ে ফলমূল ও শাকসবজি, মাছ, মাংস খেলে তা আমাদের শরীরে কোনো ক্ষতি না করে উপাদেয় হবে?

আমরা কেমিকেলের কথা শুনলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পরি। খাদ্যে অনুমোদিত মাত্রায় কেমিকেল ব্যবহার করা হলে তাতে ক্ষতির কোনো কারণ নাই। ফলমূল শাকসবজি যদি কাঁচা অবস্থায় খেতে চান, তাহলে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে খেলে অসুবিধা হবেন না। খোসা ছাড়িয়ে যেগুলো খাওয়া হয়, তাতে কোনো সমস্যা নাই, আর রান্না করা খাবার ভালো করে সেদ্ধ করে খেলে, ক্ষতিকর জীবাণু থাকে না। বর্তমানে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে, খাদ্যদ্রব্যে যে মাত্রায় খাদ্যে দূষণের কথা বলা হচ্ছে তা হলে আমাদের এতদিন বেঁচে থাকার কথা না। ভুল তথ্য ও ভুল যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে খাবারকে দুষিত বলা হচ্ছে।  

কোনো ভোক্তার যদি মনে হয় কোনো খাবারে ভেজাল আছে, তাহলে সে কার কাছে কিভাবে অভিযোগ করবে?

ভোক্তা সরাসরি আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারে। ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য প্রমাণসহ আমাদের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। কিংবা নিকটস্থ নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক যারা আছে, তাদের কাছেও অভিযোগ করতে পারে। অথবা সে নিজেও মামলা দায়ের করতে পারে। আমাদের এখানে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিং প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।


বাংলা ইনসাইডার/আরকে/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭