ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার আপোষ নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 24/09/2018


Thumbnail

ছেলে-মেয়ে বড় হলে বাংলাদেশে এখনো বিয়ের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা পাত্র-পাত্রী খুঁজে ফিরি। নিজের সামাজিক অবস্থান ভেদে আমরা নানা রকমের পাত্র-পাত্রী খোঁজ করি। পাত্রী খুঁজতে গিয়ে পাত্রীর বাব বা মা কেমন হতে হবে, পাত্রীর রূপ, মেধা, অন্যান্য গুণ, বংশ মর্যাদা, উচ্চতা, দীঘল কালো চুল না খাটো চুল, চোখ ও দেহের গড়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ইত্যাদির যে বর্ণনা দেওয়া হয়, তা বাস্তবে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনে হয় মহাপ্রভুর কাছে এইটার পুরা বিবরণ দিয়ে একটা অর্ডার প্লেস করতে পারলে হয়তো উনি সেইমত তৈরি করে দিতে পারবেন। তাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই তখন তাঁদের চাহিদার তালিকা ১০/১২ টা থেকে চলে কাট-ছাঁট, আপোষ। এভাবে তালিকা ছোট হতে হতে কখনো কখনো ৬/৭ টায় নেমে আসে। তার পরে যোগাড় হয় পাত্র বা পাত্রীর। হয় বিয়ে, সামাজিক বা পারিবারিক ভাবে।               

আপোষ শুধু ছেলে মেয়েদের বিয়ে করাতে বা দেওয়াতেই নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা নিরন্তর আপোষ করে চলেছি, নানা ভাবে, নানা রূপে। কারণ হচ্ছে সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা অ্যাডাপ্টেশন। সময়ের সঙ্গ খাপ খাওয়াতে না পেরে বহু প্রাণী, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া কত জরুরি তা ইদানীং আমাদের দেশের মানুষ বুঝতে শুরু করেছেন। সমাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতিতেও আপোষ করা হচ্ছেন দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে। আজকাল আপোষ আর সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল খুব জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের রাজনীতিতেও।            

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ এ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। আর মোশতাক সরকার ছিল সম্পূর্ণভাবে সেনাসমর্থিত সরকার। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের পরেই জিয়া শুরু করেন তাঁর আসল আপোষ আপোষ খেলা। তিনি পলিটিশিয়ানদের জন্য ‘পলিটিক্স ডিফিক্যাল্ট’ করার মিশনে নামেন। জেলে বন্দি রাজাকার ও চৈনিক বাম যাদু মিয়াদের মত বা তার চেয়েও কুখ্যাত রাজাকার, ধর্ষক, খুনি, সন্ত্রাসী, জাসদের গণবাহিনী নামের সন্ত্রাসী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেভেন মার্ডারের সাজাপ্রাপ্ত আসামি, ইত্যাদি তামাম লোক যারা বাংলাদেশ ও মুজিব সরকার বিরোধী ছিল তাঁদের মুক্ত করে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দিলেন ইনডেমনিটি, ইত্যাদি। ফলে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ল, নিজের দেশে তারা যাতে ২য় শ্রেণির নাগরিকদের মতো বসবাস করে তাঁর সমস্ত আয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবেই করে দিলেন জিয়া। ১৯৭৫ সালে পরে শুরু করে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এবং তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া আজও ‘পলিটিশিয়ানদের জন্য পলিটিক্স ডিফিক্যাল্ট’ করে রেখেছেন। ১৯৭৩ সালে সংসদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সেখানে প্রায় ১০০ জনের বেশি সাংসদ ছিলেন পেশাজীবী মানুষদের মধ্য থেকে যাতে তাঁরা দেশের বিভিন্ন খাতের সত্যিকারের প্রতিনিধি হয়ে দেশের কল্যাণে আইন প্রণয়নসহ নানা কাজ করতে পারেন সদ্য স্বাধীন একটা দেশে। কিন্তু এখন কতজন সংসদ আছে পেশাজীবী? ডিফিক্যাল্ট টু অ্যানসার।

জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া সবাই ‘পলিটিশিয়ানদের জন্য পলিটিক্স ডিফিক্যাল্ট’ করে দেওয়ার পথে হেঁটে হেঁটে কুখ্যাত রাজাকার, অর্থলোভী ব্যবসায়ী, পেশীশক্তির পূজারী, সন্ত্রাসী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, লুটেরাদের রাজনীতিতে এনে পদ-পদবী ছাড়াও নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন। যাতে স্বাধীনতার পক্ষের কোনো শক্তি কোনোদিন আর ক্ষমতায় না আসতে পারে। এসবের বাইরেও ছিল নানামুখী ষড়যন্ত্র, যার নমুনা ১৯৯১ সালের নির্বাচনের ফল। জিয়াগংদের কূটকৌশলের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পড়ে যায় চরম নৈতিক চাপে। উপায় খুঁজতে শুরু করে তারা, বিশেষ করে দলের নেতা শেখ হাসিনা। তখন খোঁজা শুরু করেন কাদের সঙ্গে অর্থাৎ কোন কোন দলের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আপোষ করা যায়, কার সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদী নির্বাচনী আঁতাত বা জোট করা যায়, কিছু ছাড় দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে। বাকশাল গঠনের সময় জাসদ বাদে প্রায় সব দলকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন, সঙ্গে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৬ সালে নির্বাচনে আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিল ১৫ দল আর বিএনপি’র নেতৃত্বে ছিল ৭ দল, জামায়াত আলাদা আলাদা করে আন্দোলন করেছে। কোনো দিন আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে জোট করেনি, জামায়াতের কৌশল ছিল এই যে, তারা ১৫ দল, ৭, দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যাবে। তবে ১৯৯১ সালের পরে একটি ঘটনা ঘটে, তখন বিএনপি ক্ষমতায়। সংসদের একটি ওয়াক আউটের ঘটনার পর বিরোধীদলের নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের টেবিলের পাশাপাশি চেয়ারে এসে বসেছিলেন জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামী, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ আরও কয়েকজন। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কেউ নিজামীকে সেখানে ডেকে আনেননি। কৌশলী নিজামী নিজের একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরির আশায় বিরোধীদলের একজন এমপির দাবিতে বিরোধীদলের নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের টেবিলে এসে বসে পড়েছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে তখনই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ এসব কিছু পারে না। সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিক সতর্ক হয়। এরপর আর কোনোদিন নিজামী বা জামায়াতের কেউ সেই মঞ্চে এসে বসতে পারেননি। কিন্তু এটাকে ভিত্তি করে এখনো প্রতিদিন মিথ্যাচার হয় বিভ্রান্ত হয় অনেকে। আসল সত্য জানার আগ্রহ খুব কমের মধ্যে।

পরবর্তীতে দেশের রাজনীতিসহ নানা ঘটনায় আওয়ামী লীগ আর তাদের পুরাতন মিত্রদের কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে, মুখে নৈতিকতার কথা বললেও আসলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো বিএনপি’কে সঙ্গে নিয়ে মেরে কেটে বা টাকা দিয়ে বিজয়ী হবে এমন লোককে মনোনয়ন দেয়, দিয়েছে এবং দেবে এবং ক্ষমতা দখল করবে; সেখানে নীতি নৈতিকতার কোনো বালাই নেই। তাই ১৯৯১ সালের পর থেকেই আওয়ামীলীগ দলের মূল চেতনা ঠিক রেখে তাদের পুরাতন মিত্রদের সঙ্গে অল্পবিস্তর আপোষ করা শুরু করে। তাই গড়ে ওঠে ১৪ দলীয় নির্বাচনী জোট। এই প্রক্রিয়ায় ইনু সাহেবের জাসদ, এরশাদ, অনেক অবসরপ্রাপ্ত আমলা, ব্যবসায়ীর সঙ্গে কিছু গুন্ডা, পান্ডা, দলে। আমলা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর একটা বিরাট অংশ যাদের শেকড় ১৯৭১ সালে পাকিদের পক্ষে  ছিল তাঁরা বলতে গেলে পাঁচ ওয়াক্তে বা প্রহর গুনে গুনে রাজনীতিকদের গালি দেয়, দোষ দেয় দেশে ঘটে যাওয়া তাবৎ অপকর্মের; আর সুনাম নেন তাঁরা নিজে। তাঁরা ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রী হলে ‘ঝাঁকুনি তত্ত্বে’র বা ‘আল্লার মাল আল্লায় নিছে’ এমন তত্ত্বের জন্ম দেন, যখন মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনুলিখন করে মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করে টাকা কামান। জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমানরা জন্ম নেয় তখন। তাই কিছু হাইপার দেশ প্রেমিকদের মধ্য থেকেই কখনো কখনো, এই ‘কাউয়া প্রজাতির রাজনীতিবিদদের মুখে লাগাম টানতে পারে, পারে মানবতাবিরোধী ও তাদের দোসরদের লোভের আগুনে বরফ পানি ঢেলে দিতে। তাই এরা দলে অপরিত্যাজ্য ঝামেলা হয়ে রয়ে যায়, দিনের পর দিন, যতদিন তাঁরা সাধারণ মানুষের জন্য চরম হুমকি হয়ে না যায়। যদিও সব শেষে সব দোষ হয় দলের নেতা আর পেশাদার পলিটিশিয়ানদের। অনেকে বলে এটাই হচ্ছে শেখ হাসিনার ‘কুকুরকে মুগুর দিয়ে সোজা’ করার নীতি বা কৌশল!                

বিএনপি বা তার মিত্রদের সঙ্গে ‘কাউয়া প্রজাতির রাজনীতিবিদ’, আর পল্টিবাজদের মাখামাখি চরমে। তাঁরা নীতি নৈতিকতা, গণতন্ত্রের চরম ধ্বজাধারী হয়ে নানা উপদেশ বিতরণ করেন, যা তাঁরা নিজে পালন করেন না কখনোই। গণতন্ত্রের জন্য কাঁদতে কাঁদতে গলা বুক বেয়ে নোনা জলে শরীর ভিজে যায়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সময় গণতন্ত্রকে বাক্সে বন্দি রাখে ধানমণ্ডি ৩২ নং এ যায় বন্দুক হাতে গণতন্ত্রের প্রবাদ পুরুষকে হত্যা করতে, যিনি বেসিক ডেমোক্রেসি থেকে নারীসহ সর্ব সাধারণের ভোটের জন্য সারাজীবন লড়াই করে তা’ অর্জন করেছেন এই বাংলায়। তাঁরা ও তাঁদের মিত্ররা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে গণতন্ত্রকে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রেখে মারাত্মক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে কেড়ে নেয় সিকি শত প্রাণ, আহত আর পঙ্গু করেছে শতাধিক নারী, পুরুষ, শিশুকে। এই উদাহরণ দিতে গেলে তাঁরা ও তাঁদের পক্ষের সুশীলগণ বলে উঠেন, ‘তাহারা অধম বলিয়া তুমি কী উত্তম হইবে না?’ কি চমৎকার বচন! তাঁরা বুঝে গেছেন যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের খেলা ধরে ফেলেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলে তাঁরা এখন পর্যন্ত প্রায় ধরাশায়ী। প্রতিহিংসা আর সাম্প্রদায়িকতার দুধ কলা দিয়ে লালন পালন করা হেফাজত আন্দোলন এখন শেখ হাসিনার কথায় সবকিছু (নষ্টামি ছাড়া) করতে ওয়াদাবদ্ধ। তাই হতাশ হয়ে সেই তাঁরা গড়ে তুলেছে নানা জোট, উপ-জোট ইত্যাদি, সঙ্গে নিয়ে নষ্ট ভ্রষ্টদের। গণতন্ত্র মানবাধিকার উদ্ধারে একজোট হয়ে সব কিছু গেলো গেলো বলে চিৎকার করছেন তাঁরা। এটা শুনে একটা কথা মনে পড়ে:

তুমি যদি করো প্রেম 

হয় সেটা লীলা,

আমি যদি করি প্রেম

সেটা নষ্টামি খেলা।         

 

লেখক: উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

তথ্যঋণ: বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, জুলফিকার আলী, অন্যান্য

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭