ইনসাইড থট

এ এক আজব শহর!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 30/09/2018


Thumbnail

পথ চলতে চলতে সবসময়ই একটি কথা মনে হয়। আমাদের শহর কি আসলেই বসবাসের অনুপযুক্ত? সত্যি কি আমরা আমাদের শহরকে ভালোবাসি না একটুও। দিন দিন কি আমাদের শহরগুলোর মৃত্যু ঘটছে? এমন হাজারো প্রশ্ন। মাঝে মধ্যেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপে দেখা যায় ঢাকা শহরের অধঃপতনের খবর। আমরা নাকি আরও পিছিয়ে যাচ্ছি! আমাদের অবস্থান নাকি একেবারে শেষ প্রান্তে! যে শহরে কোটি মানুষের বসবাস, সে শহরে এমন অনেক কিছুই সহজে মিটবে না সেটিই তো স্বাভাবিক। একটু সচেতন হলেই দেখা যায় যে শহরগুলোর নাম শ্রেষ্ঠ শহরের প্রথম দিকে আছে তাদের প্রায় ২০ গুণ মানুষ বসবাস করছে আমাদের শহরে । কিংবা তারও বেশি। যার আয়তন সেই শ্রেষ্ঠ শহরগুলোর আয়তনের দিক থেকে আবার কয়েক গুণ ছোট। তাইতো সত্যই আশ্চর্য হই আমাদের এই ছোট্ট শহর ঢাকার কথাই যদি ধরি, দিনের পর দিন এত বিশাল বোঝা কাঁধে নিয়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে? কীভাবে সকলের প্রয়োজন মিটাচ্ছে একনাগাড়ে বিরামহীন ভাবে। বরং বৈচিত্র্যের দিক থেকে বিচার করলে আমাদের এই শহরের মতো টেকসই শহর পৃথিবীতে সত্যিই খুঁজে পাওয়া বিরল। ভাবতেই অবাক লাগে হয়তো আমাদের রাস্তাঘাট কম, তবে রয়েছে লাখ লাখ যানবাহন, যানজট আছে তারপরেও চলছে- থেমে নেই। এত মানুষ তিন বেলা পেটপুরে খাচ্ছে। এই ছোট্ট শহরে রয়েছে অসংখ্য স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর এমনটা শহর আর কেউ দেখাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। আমাদের গর্ব হওয়া উচিত এমন একটি শহরের জন্য, শহরের বাসিন্দা হওয়ার জন্য। আমি হলফ করে বলতে পারি পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরে এমন অবস্থা হলে সহসাই ভেঙ্গে পড়বে। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে চিরতরে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের এই শহরকে ভালোবাসার একটু কমতি আছে বৈকি! কিছু না পেলেই চোখ বুজে দোষ দিয়ে ফেলি সরকারকে। এই আমাদের নিজেদের কি কোনো দায়িত্ব নেই শহরকে সুন্দর রাখার জন্য? খুব কষ্ট হয় যখন দেখি সচেতন শিক্ষিত ব্যক্তিরাই রাস্তার উপর গাড়ি পার্ক করে রেখে দিয়েছে নির্দ্বিধায়। এ কাজটি তো কোনো হত-দরিদ্র মানুষের নয়, কারণ তাদের তো দামী গাড়ি কেনার সামর্থ থাকার কথা নয়। এমনকি তাদেরকে গাড়ি রাস্তায় পার্ক করা থেকে বিরত থাকতে বললেও এক প্রকার দোষ হয়। তখন তারা প্রদর্শন করেন কার কত ক্ষমতার জোড়। এমনটা হরহামেশাই দেখা যায়। আবার এই আমাদেরই জন্য শহরে তৈরি হচ্ছে পার্ক - জলাশয়। বিকেল হলে ঘুরতে বের হচ্ছি পার্কে। অবলীলায় পলিথিন কিংবা প্লাস্টিকের দ্রব্য ফেলছি যেখানে সেখানে। এমনকি জলাশয়গুলো দেখলে সহজেই এর সত্যতা পাওয়া যায়। রাশি রাশি নোংরা। আর এগুলো কিন্তু করছি আমরাই - বলা চলে সচেতন ভাবেই। তবুও যেন একটুও লজ্জা নেই। আর এই সচেতনতা যতদিন আমাদের ভেতর নিজ থেকে না আসবে আমরা ততদিন সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়েই পড়বো। শহরের জন্য মায়াকান্না করবো। লাভের কিছুই হবে না। নিজে ভালো আছি, অন্যদের অবস্থা দেখার সময় নেই - এমন স্বার্থপরতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কাজে লাগাতে হবে নিজেদের প্রযুক্তি টেকসই উন্নয়নের জন্য।

এই তো সেদিন। আমার কাছের একজন সকালে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ ম্যানহোলের ঢাকনার উপর পা দিয়ে নিচে পড়ে গেলেন। সেই রাস্তাটি মেরামতের কাজ চলছিল প্রায় বছর ধরে, কিংবা তারও বেশি। কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ম্যানহোলটির ঢাকনা লোহার সঙ্গে আটকানো কিংবা ঝালাই করা ছিল না। সুতরাং দেখে বোঝার উপায় নেই পা দিলে কেউ সহজেই নিচের ড্রেনে পড়ে যাবে। ভাগ্যিস ড্রেনটি ছিল অগভীর। নইলে যে কেউ যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদে পড়তে পারতো। সবচেয়ে অবাক হলাম বিষয়টি যখন দায়িত্বপ্রাপ্তদের জানানো হলো - তারা একজন আরেক জনকে দেখিয়ে দেয়। কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। এগুলোই আমাদের বড় সমস্যা। যার যার কাজ সবাই যদি দায়িত্ব সহকারে করে তাহলে আমাদের যে সম্পদ আছে সেটা দিয়ে অনেক আগেই আমরা আরও বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারতাম নিঃসন্দেহে। আমাদের দেশে বর্তমানে কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট কিংবা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অভাব নেই - সরকার প্রধানের চেষ্টারও কোনো কমতি নেই বিন্দুমাত্র। তবে অভাব আছে আমাদের নিজেদের আন্তরিকতার। আর এই আন্তরিকতার অভাবের কারণেই সবকিছু থেকেও আমাদের অনেক কিছুই হচ্ছে না ঠিকসময়ে। যে কেউই ক্ষমতায় আসুক না কেন, কারও পক্ষেই শুধুমাত্র আইন দিয়ে শহরকে সুন্দর করা সম্ভব নয় মোটেও, যদি না আমরা নিজেরাই আগে না শুধরাই।

এবার আমাদের ভাবতে হবে একটু অন্যভাবে। বর্তমানে মানুষ-কেন্দ্রিক শহরগুলো সবুজ শহরের নকশার উপর সবথেকে বেশি জোর দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের শহরকেন্দ্রিক মেয়রগণ বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র কে সাধুবাদ জানাতেই হয় - তাদের কিছু কর্মপরিকল্পনার জন্য যার মধ্যে বেদখল জমির ব্যবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত প্যাকিং উচ্ছেদ, বিশেষ করে বর্তমানের ‘জল সবুজের ঢাকা’ প্রকল্পটি যদি সঠিক ভাবে বাস্তবায়িত হয়, যদি খেলার মাঠ গুলো পুনরুদ্ধার হয়, তাহলে কিছুটা হলেও সুখের মানদণ্ডে আমরা একটু এগিয়ে যাবো বৈকি। আর ‘জল সবুজের ঢাকা’ এর মতো প্রকল্প চট্টগ্রাম সহ দেশের সকল শহরগুলোতে পরিচালিত হওয়া বিশেষ ভাবে জরুরি। এছাড়াও গাড়িমুক্ত দিন, কিংবা গাড়ি মুক্ত অঞ্চল, জনসাধারণের ব্যাবহারের জন্য জমি পুনরুদ্ধার, শহুরে নাগরিকদের শহরকেন্দ্রিক স্থান সমূহের উপলব্ধি করার প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করে। যার দরুন প্রতিনিয়ত তারা শহরকে নিজেদের মতো ভালোবাসতে শেখে। মোটকথা আমাদের শহরকে আমাদেরই ভালোবাসতে হবে সঠিকভাবে। ব্যক্তি স্বার্থের চিন্তা বাদ দিয়ে জনস্বার্থের চিন্তা মাথায় নিয়ে আমরা যদি নিজেদের রাস্তাঘাট নিজেরাই পরিষ্কার রাখি, সঠিক নিয়মে গাড়ি চালাই, ফুট ওভারব্রিজ কিংবা যেটুকু ফুটপাথ আছে সেগুলোই নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ব্যাবহার করি, তাহলে হয়তো আমরাই একটি সময়ে সবার উপরে থাকবো। বিশ্ব তখন তাকিয়ে দেখবে এত ছোট পরিসরের জায়গায় এত সুবিশাল মানুষ নিয়ে আমরা কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। আর তখন সেটাই হবে দৃষ্টান্ত।

একটি আশার গল্প দিয়ে শেষ করছি। ঢাকা শহরের পরিচিত একটি রাস্তায় চলছি। হঠাৎ দেখতে পেলাম বেশ কিছু স্কুল ড্রেস পরিহিত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ডাস্টবিনের আশপাশ থেকে ময়লাগুলো তুলে ডাস্টবিনে ফেলছে। জানি না পাশে কোনো শিক্ষক দাঁড়িয়ে ছিলেন কিনা! তবে, হয়তো এই আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার থাকবে আমাদের।

লেখক: শিক্ষক ও পরিবেশ বিষয়ক স্থাপত্য গবেষক
স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭