ইনসাইড থট

কোটা আন্দোলন ও মুক্তিযোদ্ধার রক্তের ঋণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/10/2018


Thumbnail

যারা এখন আমার এই লেখা পড়ছেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে একটা গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। আজ থেকে ৪০/৫০ বছর পরে আপনারো অনেক বয়সী হবেন। তখন আপনাদের নাতি পুতিদের কাছে যখন বলবেন যে, আপনাদের শৈশবে বাসায় মোবাইল ফোন, ল্যাপ্টপ, কম্পিউটার, ট্যাব, পিএইচফোর, ইত্যাদি ছিল না। তখন আপনাদের নাতি পুতিরা আপনাদের ছেলে মেয়েকে বলবে যে নানু /দাদুর মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে, তাড়াতাড়ি ডক্টরের কাছে বা হাসপাতালে নিতে হবে। ওরা এটা বিশ্বাসই করতে পারবে না যে কোন শিশু, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব, পিএইচফোর, ইত্যাদি ছাড়া বড় হতে পারে। তখন আপনার ছেলে বা মেয়ে অনেক কষ্টে তাদের ম্যানেজ করবে বটে কিন্তু শিশুরা তাদের মন থেকে তা মেনে নেবে না। আমরা এখন যখন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন অনেকের কাছেই এমন অবস্থা দাঁড়ায়, তারা মেনে নিতে পারে না তখনকার বাস্তবতা।  

১৯৭১ সালে আর্মি, ইপিআর, পুলিশ বাদে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাঁদের বয়স ছিল গড়ে ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে। বাড়ন্ত শরীরের সামান্য কিছু ছিল কিশোর মুক্তিযোদ্ধা যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ এর মধ্যে। তাহলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বাদ দিলে গড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ২১.৫ ধরা যায় যাদের বর্তমান বয়স ২০১৮-১৯৭১=৪৭+ ২১.৫= ৬৮.৫ বছর। আমাদের দেশের সরকারী চাকরীতে ঢোকার বয়স ছিল  সাধারণত ২৭ বছর আর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩২ বছর। মানে ১৯৮২ সালের পরে আর কোন মুক্তিযোদ্ধার সরকারী চাকরীতে আবেদনের বয়স থাকার কথা নয়। বিসিএস ১৯৮৬ সালের ব্যাচের পরে (আবেদন করা ছিল আগেই) তাই আর কোন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরী পান নি।   

এবার দেখে নিই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কতভাগ লোক যোগ্য স্নাতক ছিলেন যারা প্রথম শ্রেণীর সরকারী চাকরীর আবেদন করতে পারতেন। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব  পাকিস্তানে ২৮,০০০ লোক স্নাতক ছিলেন। যা আগের ১০ বছরের তুলনায় ৩২.৩ শতাংশ কম। মানে তাঁরা ধর্মীয় বিবেচনায় হিন্দু ছিলেন বলে শক্তভাবেই অনুমান করা যায়। ১৯৪৭ সাল থেকে এই বাংলায় মুসলিমরা সাধারণ শিক্ষার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় বেশী মনোযোগী ছিলেন এই কারণে যে, ভারত ভাগ হয়েছিলো হিন্দু মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, হয়েছিলো হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা অনেক একাকায়, ভয়াবহ ছিল তা।  ১৯৪৬/৪৭ চরম দাঙ্গা হয়েছিলো। এরপরেও দাঙ্গা হয়েছিলো ১৯৫০ সালে। এই বেলা পত্রিকার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, দাঙ্গার কারণে শুধু ১৯৫০ সালে ১ মাসেই ৫০ লাখের বেশী হিন্দু এপার বাংলা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় অপার বাংলায়। সে সময় ছাত্ররা ক্রেডিট ট্রান্সফার করেও চলে গেছেন অনেকে। যার ফলে আমাদের এই বাংলার একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর মাঝে সাধারণ শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুব কম ছিলো। শুধু ঢাকার কয়েকটা স্কুলের ১৯৫০ সালের চিত্র আমরা উইকিপিডিয়া থেকে দেখে নিতে পারিঃ        

ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষার্থীর সংখ্যা

বিদ্যালয়

ছাত্র/ ছাত্রী

জানুয়ারী ১৯৫০

ডিসেম্বর ১৯৫০

প্রিয়নাথ হাই স্কুল

ছাত্র

১৮৭

 পোগেজ স্কুল

ছাত্র

৫৮০

৫০

কে এল জুবলি স্কুল

ছাত্র

৭১৯

৫২

গেন্ডারিয়া হাই স্কুল

ছাত্র

২৪৫

১০

ইস্ট বেঙ্গল হাই স্কুল

ছাত্র

২০৪

১৬

নব কুমার ইন্সটিটিউট

ছাত্র

৫১

নারী শিক্ষা মন্দির

ছাত্রী

২৭৫

বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়

ছাত্রী

৬০৬

আনন্দময়ী বালিকা বিদ্যালয়

ছাত্রী

৭৫

গেন্ডারিয়া বালিকা বিদ্যালয়

ছাত্রী

২৭৭

১০

            

উপরের চিত্র দেখলেই অনুমান করা যায় যে কত সংখ্যক মুসলিম এই বাংলায় সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাইতেন। যেহেতু পরিসংখ্যান নেই তাই উপরের এই তথ্য থেকে সহজেই দাবি করা যায় যে, ১৯৭১ সালে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রী পাশ মুসলিম ছেলে মেয়ে আমাদের দেশে খুব কম ছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন যারা তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের তথকথিত অশিক্ষিত গরীব যুবকেরা। যুদ্ধ শেষে যারা ঘরে ফিরে এসে দেখেছেন তাঁদের অধিকাংশের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। গরু ছাগল লুট করেছে রাজাকারের দল, মাঠে ফসল নেই, ফসল উৎপাদনের উপায় বা সামর্থ্য নেই। তাঁরা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আর্থিক কষ্টে অধিকাংশেই নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারেননি, বরং মাঠে কাজ করিয়ে বা শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। কারণ স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু মাত্র ৩ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ৫০ টাকা হারে (মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের মত) ভাতা দিয়ে টাকার অভাবে আবার তা বন্ধ করে দেন। এর পরেই আসে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। যা বাংলার মানুষের জীবন লণ্ডভণ্ড করে দেয়। 

তাই সেই তথকথিত অশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের সন্তানেরা তো দুরের কথা তাদের নাতিদের অনেকেই এখনো সরকারী চাকরীতে আবেদনের শিক্ষগাত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি, কারণ অর্থাভাব। আরেকটি কারণ হল এইসব গ্রামের তথকথিত অশিক্ষিত গরীব মুক্তিযোদ্ধা যুবকেরা বিয়ে করতেন অনেক কম বয়সে। নিজেরা আর তাদের সন্তানেরা অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে বড় হয়েছেন, তাই ব্রেইনের গঠন ঠিকমত হয়নি পুষ্টির অভাবে, যেমনটি ঘটে উপজাতি শিশুদের ক্ষেত্রে। স্বাধীনতা বিরোধী অনেক উপজাতি গোষ্ঠীর শিশুদের অনগ্রসর বলে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দেয়া হয় বংশ পরম্পরায় কিন্তু একই সমস্যায় পতিত মুক্তিযোদ্ধার নাতিদের বেলায় সেই সুবিধা দিয়ে বাধে আমাদের বিবেকে! কি অবাক আমাদের বিবেকবোধ!

যা হোক, এরপরেও ১৯৭৫ থেকে ২০০৬ মানে গড়ে ৩১ বছর বিশেষ করে বিএনপি আমলে তেমন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বা তাঁদের সন্তানদের চাকরী দেয়া তো হয়ই নি বরং মুক্তিযোদ্ধা বললে কোন কোন ক্ষেত্রে চাকরীতে অযোগ্য বিবেচনা করা হয়েছে। তবে দিলীয় বিবেচনায় প্রয়োজনে কিছু নিজেদের লোকেদের চাকরী দেয়া হয়েছে যারা অধিকাংশই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়, ফলে হালে চার জন সচিব ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটসহ ধরা পড়ে চাকরি হারিয়েছে। এদের সংখ্যা অনেক কিন্তু যারা ধরবেন, তারাই তো এই অকাম করেছেন তাই তারা ধরা পড়ে কালে ভদ্রে। বদনাম হয় মুক্তিযোদ্ধার। ভাবটা আর প্রচার এমন যেন মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছেন। মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকা দরকার। তার পরেও বহু মানুষ এ কথা বিশ্বাস করেন।

ইদানিং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকরীতে নিয়গে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিল করেছেন। তার প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা রাস্তায় নেমেছেন, তাঁরা সংখ্যায় অনেক কম। তা নিয়েও অনেকে টিটকারী মারে। আমি হাসি বোকার মত করে। ২ লাখ মতান্তরে ৩ লাখ সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ১৯৭১ সালে যাদের অধিকাংশের বয়স এখন ৭০ এর কাছাকাছি। তাদের ছেলে-মেয়েরা অধিকাংশই ছোটখাটো কিছু কাজ করে হয়তো এখনো বেঁচে আছেন। তাদের পক্ষে বেসরকারী চাকরী ছেড়ে মিটিঙে যোগ দেবার না আছে পয়সা না আছে সময়। ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ২ লাখ বা ৩ লাখ যুবক-যুবতী যখন দেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম করেছে তখন কিন্তু এই কম সংখ্যা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্চ করেন নি আপনারা। কারণ তাতে আপনাদের জীবনের ঝুঁকি ছিল। এখন তাই খুব সহজেই টিটকারী মারতে পারেন, জনসমাগমের সংখ্যা নিয়ে, সাবাস আপনাদের। বুড়ো হলে আপনারা আপানেদের অধিকাংশই যে নিজেদের বাবা মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন, তাতে আমার কোনই সন্দেহ নেই। কারণ তারা আপনাদের জন্য বাড়িটা বানিয়েছেন, আপনাদের মেধাবী করার জন্য নিজেরা প্রায় না খেয়ে, না পরে কষ্ট করেছেন। তার প্রতিদান আপনারা তো দেবেন এভাবেই, তার লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি যারা আপনাদের দেশ আর মানচিত্র উপহার দিয়েছেন তাঁদের আর তাঁদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আচরণে।

তবে এই রাতের আঁধার শেষ হবে, রাতের আঁধার কাটবে। এটা ১৯৭৫ নয়, এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ। একদিন ওরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা সব জানবে, তখন এগিয়ে আসবে দল বেঁধে, সুদে মূলে হিসাব নিতে, আমরা অনেকেই সেই দিনটার অপেক্ষায় আছি, থাকবো, নিজের সন্তানদের সেই দিনের অপেক্ষায় থাকতে বলবো, সরকারি চাকরীর জন্য নয়, অসম্মানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বলে যাবো। বলবো এটাই হচ্ছে তোমাদের ঋণ পরিশোধের একমাত্র এবং একমাত্র উপায়। পশুর মত নয় মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচতে হয়, মানুষকে তাঁদের ত্যাগের জন্য প্রতিদান না দিতে পারলেও সম্মান দিতে হয়।                  

লেখকঃ উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

তথ্যঋণঃ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, উইকিপিডিয়া, মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলী খান, অন্যান্য



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭