ইনসাইড আর্টিকেল

অ্যাঙ্গেলা মেরকেল: মমতাময়ী এক লৌহমানবী?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/10/2018


Thumbnail

বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর একটি দেশের ক্ষমতার শীর্ষে পৌছাবেন, এতটা আশা করেননি তাঁর সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষীরাও। কিন্তু শান্ত-সৌম্য আচরণের মেয়েটি এখন টানা চতুর্থ মেয়াদে জার্মানির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শুধু নিজ দেশই নয়; ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-সেভেন এর মতো আন্তর্জাতিক জোটগুলোতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তিনি। তিনি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল।

মেরকেলের উত্থান

সাবেক পূর্ব জার্মানির ছোট এক শহরের যাজক-কন্যা অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শক্ত হয় সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের আমলে। দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর গঠিত প্রথম মন্ত্রিসভায় নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তাঁকে দেওয়া হয় পরিবেশ আর পারমাণবিক সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এ সময়ে দলে তাঁর অবস্থান আর মতামতও জোরালো হতে থাকে। কোল তাঁর মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ এই সদস্যকে ‘মেইন মাদচেন‘ বা ‘আমার কন্যা’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে কোলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলই প্রথম এর প্রতিবাদ করেন। নিজের রাজনৈতিক পিতার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাঁর একটি পরিচ্ছন্ন ইমেজ তৈরি হয়।

কোল ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর পর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল পার্টির প্রধান নির্বাচিত হন। এ বিষয়ে হেলমুট কোল এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি একটি সাপকে আশ্রয় দিয়েছিলামI সে’ই আমার পেছন থেকে ছুরি চালালো। ‘জার্মানির ইতিহাসের প্রথম নারী চ্যান্সেলর হিসেবে ২০০৫ সালে দায়িত্ব নেন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। এরপর থেকে শুধু তাঁর উত্থানই দেখেছে বিশ্ব।

টিকে থাকার কৌশল

২০০৫ সাল থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেরকেল। উন্নত বিশ্বের একটি দেশে এত দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকা বিস্ময়করই বটে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন প্রতিনিয়ত মানুষের রুচি,পছন্দ অভিমত বদলে যাচ্ছে, তখন কোন জাদুবলে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখছেন মেরকেল, এমন প্রশ্ন করেন অনেকেই।

বিশ্লেষকরা বলেন, প্রশংসা এবং বিতর্ক দু’টি বিষয়ই ধীর-স্থিরভাবে সামাল দেন মেরকেল। যেকোনো সমস্যা হলে প্রথমে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন পরিস্থিতিটা কোন দিকে যাচ্ছে। এরপর খুব সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন বলেও মনে করেন অনেকে৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুতই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন মেরকেল। প্রয়োজন হলে নিজের মতামত সংশোধন করে নিতেও দ্বিধা করেন না তিনি। ফুকুশিমায় আণবিক বিপর্যয়ের পর পারমাণবিক শক্তি উত্পাদনকেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মেরকেল। অথচ তিনিই একসময় আণবিক শক্তি উত্পাদন কর্মসূচির জোরালো সমর্থক ছিলেন।

সাবেক পূর্ব জার্মানির পরিবেশ ও শিক্ষা-দীক্ষাই মেরকেলের খাপ খাওয়ানোর মানসিকতা তৈরি করেছে বলে মনে করা হয়। তাঁর জীবনী লেখক বয়েস-এর মতে, ‘মেরকেল এমন এক সিস্টেমে বেড়ে উঠেছেন, যেখানে যা চেয়েছেন তা পাননি। আর এই না পাওয়ার বিষয়টিই ছাপ ফেলেছে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। খুব অল্প বয়সেই তাঁকে যতদূর সম্ভব খাপ খাইয়ে এবং সতর্কতার সঙ্গে পথ চলা শিখতে হয়েছে৷’

ব্যক্তিগত জীবন

নিজের ব্যক্তিগত জীবন সবসময়ই আড়ালে রেখেছেন মেরকেল। ১৯৭৮’এ তৎকালীন পূর্ব জার্মানির কার্ল মার্ক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করেন তিনি। বার্লিনের সেন্ট্রাল ইন্সটিউট অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে গবেষক হিসেবেও কাজ করেন তিনি। সেসময়ই কোয়ান্টাম রসায়নবিদ জোয়াকিম সয়্যারের সংগে পরিচয় হয় তাঁর। দু’জনের রসায়ন গড়ায় বিয়েতে।

মেরকেল সরকারি প্রাসাদের বদলে নিজের বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করেন বলে জানা যায়। বার্লিনের ‘মিউজিয়াম আইল্যান্ড’র কাছে একটি পুরনো ফ্ল্যাটেই থাকেন তিনি ও তার স্বামী। ছুটি পেলেই দুজনে চলে যান উকারমার্ক নামের ছোট্ট একটি শহরে। ব্যস্ততা না থাকলে সুপার মার্কেটে গিয়ে সাপ্তাহিক বাজার করেন মেরকেল। এমনকি চুল কাটাতে নাপিতের দোকানেও চলে যান।

পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী মেরকেল ফ্রেঞ্চ চিজ বা পনির খেতে ভালবাসেন বলে জানা যায়। দামি পোশাক পরিচ্ছদের চেয়ে মজাদার খাওয়া-দাওয়াই তাঁর কাছে প্রাধান্য পায়। এক নির্বাচনি প্রচারণায় মেরকেল জানিয়েছিলেন, তিনি কেক তৈরি করতে ভালোবাসেন৷ আর তা মনমত না হলে স্বামীর অনুযোগও শুনতে হয় তাঁকে।

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে অনভ্যস্ত মেরকেল বলেন, ‘আমি একজন ভদ্র মানুষ৷ আমাকে যা প্রশ্ন করা হয় তার উত্তর দেই৷ কিন্তু ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বললে অভিযোগ করা হয়, আমি রাজনীতি সম্পর্কে কেন বলছি না৷ আবার রাজনীতি সম্পর্কে কথা বললে সমালোচনা করা হয়, শুধু রাজনীতিতেই কেন আমার আগ্রহ৷`

সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত মেরকেল শারীরিক এবং মানসিকভাবে ‘ফিট’ থাকতে সময় পেলেই স্বামীকে নিয়ে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে পছন্দ করেন।

বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর এই নারীকে নিয়ে ফোর্বস লিখেছে, মেরকেল হলেন সত্যিকারের এক বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রধান৷ একই সঙ্গে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও ‘অবিসংবাদিত` নেতা৷ তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঋণভার স্থিতিশীল করতে এবং ১৭ সদস্যের ইউরো মুদ্রা অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

লৌহমানবী নাকি মমতাময়ী?

অনেকেই মেরকেলকে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। নিজের দৃঢ় অবস্থানের কারণে তাকে লৌহ মানবীও বলেছেন অনেকে। কিন্তু মেরকেল বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু মাত্র লৌহমানবী নন, মমতাময়ীও বটে। ভুমধ্যসাগরে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী যখন নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছে। শরনার্থীবোঝাই  নৌকাডুবিতে যখন নারী ও শিশুসহ শত শত মানুষ প্রান হারাচ্ছে, মেরকেল তখন জার্মানির সীমান্ত খুলে দেন। নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও শরনার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁর এ সিদ্ধান্তের কারণে মাত্তি বা মমতাময়ী মা বলা হয় তাকে।

বাংলা ইনসাইডার/এএইচসি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭