ইনসাইড পলিটিক্স

যেভাবে এলো সংলাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/11/2018


Thumbnail

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একে দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা বলে চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গঠন থেকে শুর করে আজকের সংলাপ পর্যন্ত আসার পথ পরিক্রমাটি খুব একটা সরল ছিল না।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গেল সেপ্টেম্বরের গোঁড়ার দিকেই সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক জোট গঠনের লক্ষ্যে তোড়জোড় শুরু হয়। প্রথমে এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখায় ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এবং অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট। পরবর্তীতে এই ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল যুক্ত হয়। কিছু দিন পর আবার বিএনপি-জামাত প্রশ্নে জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত বিকল্পধারা ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে যায়।

পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহের আলোচনা ও দরকষাকষির পর বিএনপিসহ চারটি রাজনৈতিক দল নিয়ে জোট গত ১৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জাতীয় নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি থাকতে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই জোটের ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা হিসেবে মনোনীত করা হয় গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে।

গঠিত হওয়ার দিনই ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দিয়ে সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, সকল রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিতকরণসহ ৭ দফা দাবির ঘোষণা দেয়। এছাড়া ক্ষমতায় গেলে ১১টি লক্ষ্য পূরণেরও ঘোষণাও দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রথম থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারবিরোধী অবস্থান নেয়। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায় তারা। এছাড়া কারণে-অকারণে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করতে থাকেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ। এছাড়া খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জনের চিন্তাভাবনাও শুরু করে দলটি।

এক পর্যায়ে ২৩ অক্টোবর সিলেটে জনসভা করার ঘোষণা দেয় নবগঠিত এই রাজনৈতিক জোট। কিন্তু প্রাথমিকভাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে জনসভার অনুমতি দিতে অপারগতা জানায় প্রশাসন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২১ অক্টোবর বিএনপির সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন । রিট করার প্রায় দুই ঘণ্টা পর সেদিনই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) পক্ষ থেকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। পরে ২৪ অক্টোবর সিলেট নগরের রেজিস্টারি মাঠে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সমাবেশের পরের সপ্তাহেই গত রোববার সংসদ ভেঙে দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনসহ সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। চিঠিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়। ধারণা করা হয়েছিল এই সংলাপের আহ্বানে সাড়া দেবে না আওয়ামী লীগ।

কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি এবং ১১ দফা লক্ষ্য সংবিধানবিরোধী। এছাড়া জোটের দলগুলোর সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসূত্র থাকায় এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে জোটের অন্যতম দল বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের নেতারা।  কিন্তু হঠাৎই পাল্টে যায় পরিস্থিতি।  প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চিঠি পাওয়ার পরদিনই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সংলাপের জন্য ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে আমন্ত্রণ জানান তিনি। গত মঙ্গলবার সকালে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের কাছে আমন্ত্রণের চিঠিটি পৌঁছে দেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ড. কামাল হোসেন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না,  বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ ১৬ নেতাকে চূড়ান্ত করা হয়। আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ ২১ জন অংশ নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংলাপের আমন্ত্রণের চিঠি পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দকে নৈশভোজের আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর ‘চাচা’ অর্থ্যাৎ ড. কামাল হোসেনের আপ্যায়নে ড. কামালের প্রিয় চিজকেকসহ নৈশভোজের জন্য ১৭টি পদ চূড়ান্তও করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় নৈশভোজে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বিএনপির এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নৈশভোজের আয়োজন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এখন তাদের আপ্যায়নে গণভবনে চা চক্রের আয়োজন করা হয়েছে যেখানে পিঠাসহ বিভিন্ন নাস্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সংলাপকে কেন্দ্র করে লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক জিয়া ইতিমধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং রুহুল কবির রিজভীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ফোনে তিনি সংলাপের ব্যাপারে নিরুৎসাহ দেখিয়ে বলেছেন সংলাপ করে কী হবে?

তবে বিএনপির একটি অংশ সংলাপের ফলাফল নিয়ে আশাবাদী না হলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতা সংলাপের ইতিবাচক ফলাফল আসবে বলে মনে করছেন। ড. কামাল হোসেন, মোস্তফা মহসীন মন্টু এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো নেতারা সংলাপ নিয়ে খুবই আশাবাদী বলে জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্টের একাধিক সূত্র।

এভাবেই নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার পর আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত সেই সংলাপ। নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার সংলাপকে গণতন্ত্র চর্চার ধারায় আশা জাগানিয়া পদক্ষেপ বলে মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচটি/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭