ইনসাইড থট

বিএনপি, ঐক্যজোটের প্রতীক নিয়ে চরম জটিলতা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/11/2018


Thumbnail

বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২৩ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ৩০ ডিসেম্বর করার ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। পরিবর্তিত তফসিলে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৮ নভেম্বর। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আদালতের নির্দেশ মানার কোনো লক্ষণ নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে দেখা যাচ্ছে না। যদিও গত ৩ নভেম্বর ২০১৮ রাতে নির্বাচন কমিশনের ৩৮তম কমিশন সভা শেষে ইসি সচিব বলেন, ‘বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্রে কিংবা নির্বাচন কমিশনের আইন-কানুনে যাই থাকুক না কেন আদালত যে নির্দেশনা দেবে সেটা মানা আমাদের জন্য একেবারেই বাধ্যতামূলক।’  

তাদের এই কথার ব্যাখ্যা দিয়ে কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ধরেন, আমাদের আইন-কানুন মেনে একজন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল বলে ঘোষণা করেছি। কিন্তু তিনি যদি আদালতে রিট আবেদন করেন এবং আদালত তা আমলে নিয়ে মনোনয়নপত্র বতিল না করতে নির্দেশ দিলেন তখন তো নির্বাচন কমিশন সেই নির্দেশ মানতে বাধ্য।’

জানা গেছে, আদালতের দুটি নির্দেশনা আছে আর তা হচ্ছে- বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করা এবং এক মাসের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি করা।

বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্রের গ্রহণ করবেন কি না- এমন এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব বলেন, ‘যেহেতু বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্রেরে বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা আমাদের কাছে এসেছে, সেহেতু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা নথিটি কমিশন সভায় উপস্থাপন করব।’

বিএনপির চেয়ারপারসন পদে খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন পদে তারেক রহমান থাকতে পারবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমরা এখনো কোনো আলোচনা করিনি। রিট পিটিশন, যিনি আবেদন করেছেন তার আবেদন এবং আদালতের রায় পর্যালোচনা করে আমরা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’ কিন্তু সেই কবে এ সংক্রান্ত নথিটি কমিশনের সভায় উত্থাপিত হবে তা তিনি জানাননি, জানায়নি নির্বাচন কমিশন।

উল্লেখ্য, গত ৩১ অক্টোবর হাইকোর্ট এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনকে বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন।     

মিডিয়ার খবরে দাবি করা হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া দুর্নীতি মামলায় সাজা হবে এবং তার ফলে দল ভেঙে যেতে পারে এই আশঙ্কায় দলের গঠনতন্ত্রের ৭ নং বাদ দিয়ে বিএনপি তাদের সংশোধিত গঠনতন্ত্র ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ রোববার নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার (সিইসি) কাছে সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমা দেয়। কিন্তু, গত ১৮ নভেম্বর ২০১৮ সকাল ০৯:০৭ মিনিটেও বিএনপি’র ওয়েব সাইটে তাদের গঠনতন্ত্রের ৭ (ঘ) ধারাটি বহাল দেখা যায়।  বিএনপি’র চেয়ারপারসন আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুর্নীতি মামলায় সাজা পেয়েছেন।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ তাঁরা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।

বিএনপির গঠনতন্ত্রের কিছু ধারায় কষ্ট করে আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারি। যারা এনজিও, সিবিএ, পেশাজীবী সংগঠন, রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র তৈরি করেন বা এটা নিয়ে কাজ করেন তাঁরা এটা পড়লে খুব দক্ষ লোক যে বিএনপির গঠনতন্ত্র তৈরি করেন নি বা বিশেষ উদ্দেশ্য তৈরি করেছে তা সুস্পষ্ট। বিএনপির গঠনতন্ত্র বিএনপির চেয়ারম্যানকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, ...... এবং অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের পদবী, দায়-দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ারম্যান নিজে নিরূপণ করবেন। 

গঠনতন্ত্রের ৪ নং শব্দার্থ ধারার (ঘ) চেয়ারম্যান শব্দটি ক্ষেত্র বিশেষে চেয়ারপার্সনকেও বোঝাবে বলা হয়েছে।

বিএনপি’র গঠনতন্ত্রের ৫ ধারায় দলের সদস্য হবার যোগ্যতা, অযোগ্যতা, সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। 

ধারা ৬ এর (১৩)তে পার্লামেন্টারি বোর্ড সম্পর্কে কী বলা হয়েছে তা জেনে নিই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য কিংবা অন্য যেকোনো নির্বাচনের জন্য দলের প্রার্থী মনোনয়নের জন্য দলের একটি পার্লামেন্টারি বোর্ড থাকবে। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটিই হবে দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড। তবে যে জেলার প্রার্থী মনোনয়নের জন্য পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা আহুত হবে সেই জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উক্ত সভায় পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য বলে গণ্য করা হবে। তবে কোনো সদস্য যদি নির্বাচন প্রার্থী হন তাঁর নির্বাচনী এলাকার প্রার্থী বিবেচনা কালে বোর্ডের সভায় তিনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। দলের চেয়ারম্যান হবেন পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভাপতি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিংবা যেকোনো নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়নের দায়িত্ব পার্লামেন্টারি বোর্ড পালন করবেন এবং এ ব্যাপারে বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।    

যে দলের তার চেয়ারপারসন আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুজনকেই আদালত অযোগ্য ঘোষণা করেছেন সেই দল কীভাবে পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা করবে? কীভাবে তারা মনোনীত ব্যক্তিকে ক্ষমতা দিয়ে দলের প্রতীক বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেবেন? বিএনপি’র গঠনতন্ত্রের গঠনতন্ত্রের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, ...... এবং অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের পদবী, দায়-দায়িত্ব ও ক্ষমতা চেয়ারম্যান নিজে নিরূপণ করবেন। তাহলে কে কাকে দায়িত্ব দেবেন? কারণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, কোনো দেশ বা দলের বা কোনো সংগঠনের গঠনতন্ত্রের এক ধারার সঙ্গে অন্য ধারার/ উপধারার সম্পর্ক থাকে। তাই এককভাবে কোনো ধারার ব্যাখ্যা বা প্রয়োগে ওই গঠনতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট ধারা/ উপধারাকে উপেক্ষা করা যায় না, আইনসংগতও নয়।        

ধারা ৯ তে বলা আছে-সভা, নোটিশ, কোরাম সম্পর্কে। এর (গ) তে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দলের চেয়ারম্যান যেকোনো সময় তাঁর ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা আহ্বান করতে পারেন। তবে প্রতি ৩ মাসে অন্তত: একবার স্থায়ী কমিটির সভা হতে হবে। বিদ্যমান (Existing) সদস্য সংখ্যার ৫০ ভাগ সদস্য নিয়ে এ সভার কোরাম গঠিত হবে।

যে দলের তার চেয়ারপারসন আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুজনকেই আদালত অযোগ্য ঘোষণা করেছেন সেই দল তাদের গঠনতন্ত্রের ৯ (গ)নং ধারার আলোকে কীভাবে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা আহ্বান করবেন? সেই সভা আহ্বান কি বৈধ হবে?

তবে হ্যাঁ, বিএনপি নতুন চেয়ারপারসন নির্বাচন করে নিতে পারে তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। এ প্রসঙ্গে কী বলা আছে বিএনপি’র গঠনতন্ত্রে, একটু দেখে নেওয়া যাক।

বিএনপি’র গঠনতন্ত্রের ধারা ৮ (ক) তে চেয়ারম্যান নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দের সরাসরি ভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে ৩ বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। মেয়াদ শেষে চেয়ারম্যান পদে একই ব্যক্তি পুনরায় নির্বাচিত হতে পারবেন। কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত চেয়ারম্যান দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এবং জাতীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন বলে গণ্য হবেন। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত চেয়ারম্যান স্বপদে বহাল থাকবেন। 

কিন্তু বিএনপি’গঠনতন্ত্রের ৯ (ক) ধারা মোতাবেক দলের মহাসচিব দলের চেয়ারম্যানের লিখিত পরামর্শক্রমে জাতীয় কাউন্সিলের সভা আহ্বান করতে পারবেন। এই ধারায় সভার কোরাম আর নোটিশ পিরিয়ডের কথা উল্লেখ করা আছে। তাতে দেখা যায় যে, ......... সুস্পষ্ট ৫ দিনের নোটিশে কাউন্সিলের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হতে পারবে (এটা চেয়ারম্যানের লিখিত পরামর্শক্রমে হতে হবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই)। বিএনপি’র মহাসচিব দলের চেয়ারম্যানের লিখিত পরামর্শক্রমে জাতীয় কাউন্সিলের সভা আহবান করবেন কীভাবে? আইনগত ভাবে কী তা সম্ভব? তাহলে কী জেলখানা থেকে বেগম খালেদা জিয়া তার দলের লোকদের সঙ্গে বৈধভাবে লিখিত নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন?

বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র প্রশ্নে আদালতের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা মানতে বা প্রয়োগে কি নির্বাচন কমিশন কালক্ষেপণ করছেন? দেরিতে হলেও সিদ্ধান্ত তো তাদের দিতে হবে। দেরিতেও সেই সিদ্ধান্ত বিএনপি’র পক্ষে যাবার সম্ভাবনা যে নেই তা বিএনপি’র সংশোধিত গঠনতন্ত্র আর আদালতের আদেশ পর্যালোচনা করলেই অনুমান করা যায়। তাই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষা আর সরকারকে বিব্রত করা তথা দেশকে একটা অস্থিরতায় না নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন কি বিএনপিকে তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। বিএনপি বহুদিন ধরেই বলছে এই নির্বাচন কমিশন সরকারের তল্পিবাহক, যোগ্যতাহীন, অক্ষম ইত্যাদি। সামনে নির্বাচন তাই বিএনপি’র সংশোধিত গঠনতন্ত্র প্রশ্নে আদালতের আদেশ মেনে নির্বাচন কমিশন তাদের সিদ্ধান্ত দেশবাসীকে জানাক। এতে বিএনপি ও কামাল হোসেনরা তাদের দ্রুত তাদের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তারা কোন প্রতীকে কীভাবে নির্বাচনে আসবে, যদি তাঁরা নির্বাচন করতে চান! মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপি’র নেতারা নির্বাচন বর্জন করে দেশে পুলিশ আর সরকারি দলের নামে কী তাণ্ডব করে তাও দেশবাসী দেখুক। কয়েকদিন আগেই তো বিএনপি’র তারেক আর খালেদাপন্থী নিপুণ চৌধুরীরা বিএনপি অফিসের সামনে অগ্নি সন্ত্রাস করে তাদের আসল রূপ আর আগামীতে কী করতে চায় তার নমুনা দেখালো।

তথ্যঋণ: বিএনপি’র গঠনতন্ত্র, অনলাইন পোর্টাল, ইত্যাদি।

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭