ইনসাইড আর্টিকেল

‘আমি রাজাকার’ প্রজন্ম

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/12/2018


Thumbnail

আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে বা দেখেনি, সবার কাছেই।  তবে মুক্তিযুদ্ধকে যারা প্রত্যক্ষ করেছে, আর যারা প্রত্যক্ষ করেনি- তাদের আদর্শ অনেকটাই আলাদা।  আমাদের বর্তমান বড় একটা প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে দেখেনি।  তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনা ধারণ নিয়ে আমরা জানতে চেষ্টা করেছি।  এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তালিকা, রাজাকারদের পরিণতি ও রাজনীতিতে আসীন থাকা, মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তরুণরা কি ভাবছে, বিজয়ের মাসে সেগুলো নিয়ে থাকছে বাংলা ইনসাইডারের বিশেষ আয়োজন ‘বিজয়ের মাসে প্রজন্মের ভাবনা’।

সাকিব রহমান

সোশ্যাল মিডিয়া এক্সিকিউটিভ, বাংলা ইনসাইডার

ছোটবেলায় গ্রামে একটা জিনিস দেখা যেত। মানুষ কাঁচের জিনিসপত্র, ঘরের প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখার জন্য ধুমধাম করে কাঠমিস্ত্রী ডেকে ‘শোকেজ’ বানাতো। বানানো শেষ হলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঢুকে যেত সেই শোকেজে। তারপর রিকশায় করে নতুন বউ নিয়ে যাওয়ার মত করে শোকেজের কাঁচ ও সামনের আয়নার ধুলোবালি যাতে না পড়ে সেজন্য কাপড় টাঙিয়ে দেওয়া হতো। মাঝেমধ্যে দু’একবার ঝাড়মোছের কাজ ছাড়া সেই শোকেজ খুলত শুধুমাত্র বাড়িতে কোন অতিথি আমন্ত্রিত হয়ে এলে।   

আমাদের কাছে শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বাঙালির মুক্তি-সংগ্রামে  জড়িত দিনগুলিও তেমন হয়ে উঠেছে আজকাল। অতিথি আসার মত করে আমরা দিবস এলেই শুধু ঢাকনা সরিয়ে স্মৃতিচারণায় মেতে উঠি আমাদের চেতনার দ্বার জাগ্রত করে। বাকি সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতাপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ প্রেম শোকেজে তালাবন্দি থাকে। কথাগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করে তাদেরই না। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতে সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হয় সেখানেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা অনেক দুঃখিত হৃদয়ে কথাগুলো বলেন। 

আমাদের ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধটাকে অস্বীকার করতে চায়। কেউ কেউ বাক্সবন্দী মুক্তিযুদ্ধকে দিবসী চেতনায় সামনে নিয়ে আসলেও তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধে নিহত-আহতের সংখ্যাটা নিছক একটা সংখ্যা মাত্র। এর একটা বড় কারণও আছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজনৈতিক পুর্বপুরুষরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটাকে ধরে রাখতে পারেননি। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী সেইসব রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর প্রধানদের পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে এদেশের নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন। তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে স্বাধীন দেশে তাদেরই গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। অথচ রাজাকারদের জন্য দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলায় একটি করে ঘৃণাস্তম্ভ নির্মাণ উচিৎ ছিল। হয়েছে উল্টোটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে যে ঘৃণাস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল সেটির উপরও আক্রমণ এসেছে। বার বার ভেঙে ফেলা হয়েছে ঘৃণাস্তম্ভ। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় ভাঙার মত নিয়ম করে অসংখ্যবার এদেশে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধার্থে নির্মিত ‘শহীদ মিনারে’ হামলা হয়, ভাঙচুর হয়!    

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হলেও এখনও নেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা। অনেকেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন এই চেতনায় যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কোনো বাড়তি সুযোগ সুবিধা আদায়ের আশায় মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাননি। তাঁদের কাছে যুদ্ধটা শুধু যুদ্ধই ছিল, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কোন লাভের আশায় তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যাননি। একাত্তরে স্বাধীনতার লড়াই শেষ হওয়ার পরে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা না করে প্রগতিশীল ঘরানার ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া। যার সুযোগে বিএনপি নামের পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনৈতিক দলের জন্ম। আর বিএনপির হাত ধরে জামাতের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ফলাফল রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর ক্ষমতায় আসা।      

মুক্তিযোদ্ধাদের যতটুকু প্রাপ্য সম্মান প্রয়োজন তাঁর পুরোটা দিতে পারেনি কোনো সরকারই। এর কারণটাও রাজনীতিতে রাজাকারদের পুনর্বাসিত করা। তাইতো স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবিতে এদেশে আন্দোলন হয়, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া হয়, কোটা বাতিলের দাবিতে ব্যানার-ফেস্টুনের পাশাপাশি এদেশের তরুণ সমাজ বুকে ‘আমি রাজাকার’ লেখার স্পর্ধা দেখায়! কি লজ্জার বিষয়।       

আওয়ামী লীগ সরকার টানা দশ বছর ক্ষমতায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। মুক্তিযোদ্ধাদের যে সুযোগ-সুবিধা, বিভিন্ন ভাতা সবই এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। যদিও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। তবুও আমি চাই এদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। আরও অন্তত ১০ বছর ক্ষমতায় থাকুক।

কেন চাই? সেটারও যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের একটা আত্মিক সম্পর্ক আছে। এক শ্রেণীর সুশীল সমাজ বলবে আওয়ামী লীগও তো হেফাজতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ক্ষমতায় গেলে হেফাজত, মোল্লাদের সঙ্গে দহরম-মহরম করবে। বিরোধিতার খাতিরে শুধু বিরোধিতা এটি নয়। এর পেছনের কারণটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সে কথা বলার আগে একটা বিষয় পরিষ্কার করি। কাদের পুঁতে রাখা বীজ আজ মহিরুহ আকার ধারণ করেছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে কারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সূচনা করেছে? রাজনীতিতে কেনাবেচার প্রচলন কাদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এদেশে? কালো চশমার সেই জেনারেলের কথা কি আপনারা ভূলে গেছেন? যার হাত ধরে এদেশে রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উঠেছিল! ডিজিএফআইয়ের লোকজন পাঠিয়ে রাজনীতিবিদ কিনে নিত নাহলে জেলে পাঠানো হতো। সেই ধারাবাহিকতা বিএনপি আজও ধরে রেখেছে। তাঁর কোনোকিছুরই ব্যত্যয় ঘটেনি আজও। নাহলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও কেন নিষিদ্ধ সংগঠন জামাত ২৪টি আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবে? খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে, জিয়ার বড়পুত্র তারেক জিয়া মামলার দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক। সুশীল সমাজের উকিল বাপ ঐক্যফ্রন্টের নেতা হয়ে তাঁর দল নিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন। কিন্তু তিনিও জামাতের ব্যাপারে চুপটি মেরে বসে আছেন।

মৌলবাদের শেকড় বিএনপি-জামাতের বিলুপ্তি না হলে কোনদিনও বাংলাদেশ থেকে মৌলবাদ দূর হবে না। বরং এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জামাতের গাড়িতে পতাকা উঠবে, ফাঁসির রায়ের পরও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ভি (বিজয়) সাইন দেখাবে, সাইদীর মত চিহ্নিত রাজাকারের বিচারের রায় শুনে চাঁদে সাইদীকে দেখাবে ভণ্ডরা, কোটা বাতিলের নাম করে বুকে পিঠে ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান লিখে রাজপথে নামবে, ড. কামাল হোসেনের মত কূট সুশীলেরা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বুলি তুলে বারবার তাঁদের রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হবে, আওয়ামী লীগ হেফাজতি হবে, বামেরা দলে দলে মক্কায় গিয়ে হজ্ব করে আসবে। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ বাস্তবায়িত হবে এই স্বাধীন দেশে। রাজাকাররা যেন রাজনীতিতে মোড়ল হতে না পারে, জামাত নামক মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল যেন ভোল পাল্টিয়ে ক্ষমতায় না বসতে পারে তাই আওয়ামী লীগ সরকার বারবার ক্ষমতায় আসুক। যতদিন বাংলার মাটিতে বিএনপি-জামাত আছে ততদিন থাকুক। ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্মের মাঝে রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজও বপন হোক।

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ/এমআর



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭