ইনসাইড আর্টিকেল

বুদ্ধিজীবী দিবস: কবে শেষ হবে যুদ্ধাপরাধের বিচার?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/12/2018


Thumbnail

১৪ ডিসেম্বর আসতে লাগতেই কেমন অদ্ভুত এক শূন্যতা, অনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলার এক দমবন্ধ করা অনুভূতির বোধ হয়। এর ঠিক একদিন বাদেই বিজয়ের দিন, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দিন। কিন্তু তার আগে এই বুদ্ধিজীবী দিবসটার কথা মনে এলেই সেই বিজয়ের আনন্দ একটু হলেও যেন ম্লান হয়।

আমরা ঐদিনের বর্বরতা নিজের চোখে দেখিনি অনেকেই। সবকিছু বিভিন্ন সময়ে লোকমুখে শোনা, ছবি বা তথ্য-উপাত্ত দেখে জানা। কিন্তু কল্পনা করলেই এর বর্বরতা, মর্মান্তিক পরিণতি বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যেই মূলত মূল বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে। তবে ১৪ তারিখে প্রকটতা ছিল বেশি। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিরবে নিভৃতেও চলেছে।

যাদের আমরা হারিয়েছি তাদের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। তাঁরা নিঃসন্দেহে দেশের সূর্যসন্তান। তাঁরা বেঁচে থাকলে নতুন একটি দেশকে পরিপক্ক করে গড়ে তোলা খুব সহজ হতো। আমাদের দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারেরা সেটাই চাননি। তাঁরা দেশকে অশুভ পরাশক্তির হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। তারা সেই পরাশক্তির কাছে এই বুদ্ধিজীবীদের চিনিয়ে দেন। তাতে সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের লাভ হতো কি? লাভ হতো তারা চাটুকারিতা করে বেঁচে থাকতো, মনের মতো করে এই সুন্দর দেশটাকে লুটেপুটে খেত।

যে বুদ্ধিজীবীদের কথা না বললেই নয়, তারা হলেন- বরেণ্য চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক এ এন এম মনিরুজ্জামান, খ্যাতনামা সুরকার ও সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, বাংলার অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক খ্যাতনামা নাট্যকার এ এন মুনীর চৌধুরী, বাংলার অধ্যাপক ও সুসাহিত্যিক আনোয়ার পাশা, সাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সমাজসেবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক রাশীদুল হাসান প্রমূখ। এদের তো নাম জানা গেছে। তবে নাম না আরও জানা অনেকেই আছে। অনেকের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। যেমন চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, এবং গল্পকার জহির রায়হান। তিনি একেবারেই নিখোঁজ।

কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়, জাতি আজও তা জানে না। শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ দেশের মেধাবী সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তিম আঘাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা অর্জনের পর গত ৪৭ বছরেও জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকা তৈরি করা যায়নি। ফলে বাঙালির এখনো অজানাই রয়ে গেল জাতির কতজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নোংরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেছে পাকিস্তানীরা। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের চোখ ও হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়, পুরো বাঙালীর দুঃখে আর ক্ষোভে মাথা নিচু হয়। আজও সেই দুঃখ আর ক্ষোভ আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।

সময় পেরিয়েছে অনেক। যারা বুদ্ধিজীবীদের ধরিয়ে দিয়েছিল, সেই বেঈমান যুদ্ধাপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি পর্যন্ত আমাদের কাছে নেই। তাই তাদের পূর্ণাঙ্গ বিচারটি আজ পর্যন্ত হয়নি। স্বাধীনতার অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য। বিচার শুরু হয়, চিহ্নিত শীর্ষ অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তিও হয়। কিন্তু প্রক্রিয়া তো এখনো শেষ হয়নি। এদের মধ্যে কেউ মারা গেছেন, অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে, কেউ আবার এখনো রাজনীতি করে যাচ্ছেন আবার কেউ পলাতক। স্বাধীন সমাজে তাদের আধিপত্য কি মেনে নেওয়ার মতো?

মানবতাবিরোধী রাজাকারদের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুষ্ঠু তদন্তের। যারা এই নারকীয় ঘটনা ঘটানোর জন্য মাস্টারপ্লান করেছিল, যাদের কাছে যাবতীয় ঘটনার নীল নকশা ছিল- তারা নিঃসন্দেহে সংঘবদ্ধ চক্র ছিল। এদের খুঁজে বের করা এবং সুষ্ঠু তদন্তের আওতায় আনার জন্য মানবতাবিরোধী একাধিকবার একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন ১৯৭৩-এর ৬ ধারার বলে তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রথম ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়। ঐদিনই প্রথম ট্রাইব্যুনালের জন্য ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হয়েছিল। আর বিচার প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট নতুন আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১২ সালের ২২শে মার্চ। বিগত দুই-তিন বছর ট্রাইব্যুনাল ও আপিলে মামলা জটের শঙ্কা থাকলেও তদন্ত সংস্থায় পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের গঠিত দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালটি কার্যকর ভূমিকা রাখলে গোটা দেশের বিচারপ্রার্থীদের অতৃপ্তি ঘোচার কথা। কেননা এটা শুধু আমাদের দেশের তাগিদ নয় তো। এটা অনেকটাই আন্তর্জাতিক ইস্যু। পুরো বিশ্বই তাদের পুরো বিচার সম্পাদনের জন্য আমাদের চাপ প্রদান করে।

মোট কথা, আমরা সবাই সোচ্চার না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ হবে না নিশ্চিত। তবে বিচারে আমরা অনেকদূরই এগিয়েছি নিঃসন্দেহে। যুদ্ধাপরাধীদের খণ্ডিত, প্রতীকী, দলীয় পর্যায়ের বিচার আমরা চাইনি কখনো। সবার আগে নিরপেক্ষ পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কমিটির দাবি আমরা করতেই পারি। গুরু পাপে লঘু দণ্ড পাওয়া এক যুদ্ধাপরাধী যখন ভি চিহ্ন দেখিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিল, তখন তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে আন্দোলনে নামতে দ্বিধা করেনি। উপযুক্ত শাস্তি তার হয়েছে। এজন্য এখন সবার একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন নয় কি?

 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭