ইনসাইড আর্টিকেল

আমাদের অর্জন, আমাদের ব্যর্থতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/12/2018


Thumbnail

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের দেশ, বাংলাদেশ। আজ ১৬ ডিসেম্বর (রোববার) মহান বিজয় দিবস। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ ৪৭ পেরিয়ে ৪৮ বছরে পা রাখলো। আজ বিজয় দিবসের দিনে আমরা যদি পিছনের দিকে ফিরে তাকাই তবে দেখি আমরা যে লক্ষ্য, আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছি তার আধিকাংশই অর্জনে সক্ষম হয়েছি আমরা। পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নেই আমাদের। সাফল্য ও ব্যর্থতার এই মাপকাঠিতে এটা বলাই যায় একটা স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি আমরা। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছিল, অনেকটা হলেও এমনই বাংলাদেশ অর্জন করতে পেরেছি আমরা। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতাগুলোও কিন্তু কম নয়। আজ বিজয়ের দিনে আমরা যদি আত্নমূল্যায়ন করি তবে দেখতে পাই, ’৭১ এর ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায়  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণায় বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯ মিনিট স্থায়ী ঐতিহাসিক সে ভাষণে মুক্তির সংগ্রাম বলতে তিনি দেশের অর্থনৈতিক মুক্তিকে বুঝিয়েছিলেন। আর স্বাধীনতার সংগ্রাম বলতে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে বুঝিয়েছিলেন। বিশ্বের বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তিনি।

বিগত ৪৭ বছরে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ আজ বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন এটি। অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়া ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙ্গালী এ স্লোগানকে ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম আমরা। নানারকম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প থাকা সত্ত্বেও আজ বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাষ্ট্র। এটিও আমাদের বড় একটি অর্জন। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্খার দিক ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, যারা যুদ্ধাপরাধী স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বিচার নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে আমরা এখন অনেকটাই সফল। ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়া ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। সে পথেও অনেকটা পথ এগিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও এখনও পুরোপুরি দারিদ্রমুক্ত হতে পারিনি আমরা, তবুও এ ব্যাপারে আমাদের সফলতা চোখে পড়ার মতো। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে বাংলাদেশের। সে পথেও অনেকটা এগিয়েছি আমরা। শিক্ষা লাভের অধিকার ও চিকিৎসা লাভের অধিকার এখন আমাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে দেশ একটি উন্নয়নশীল দেশের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এদেশের প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী বিনামূল্যে পাঠ্যসেবা পায়, প্রত্যেকটা মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পায়। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিরাট অর্জন। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় জায়গা ছিল সাম্যের সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু অনেক প্রতিকূলতার কারণে সমাজে এখনো বৈষম্য বিরাজমান। বিজয়ের ৪৭ বছর পরও অনেক কিছু অর্জন হলেও কিছু কিছু জিনিস রয়েই গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যে যে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি, সেটা যদি আমরা খতিয়ে দেখি তাহলে দেখা যাবে-

১) সমাজে আমাদের বৈষম্য বেড়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানি বড়লোকদের বিরুদ্ধে যারা আমাদের সম্পদকে কুক্ষিগত করে নিয়েছিল। আমাদের আকাঙ্ক্ষাটা ছিল এরকম যে মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা যে বাংলাদেশটা গড়বো তা সাম্যের বাংলাদেশ হবে। এতবছর পর দেখা যায় যে বাংলাদেশে বৈষম্য কমেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক বেড়েছে।

২) আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ছিল তাদের মূলোৎপাটন করতে পারিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বাধীনতাবিরোধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন জায়গায় তাদের হিংস্র থাবাই আছড় দিচ্ছে।

৩) মুক্তিযুদ্ধে একটি বড় চেতনার জায়গা ছিল ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবুর রহমান ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবেই রাষ্ট্রপরিচালনা শুরু করেছিলেন। আমাদের সংবিধানেও রাষ্ট পরিচালনার মূলনীতিতে ধর্ম নিরেপেক্ষতা ছিল। কিন্তু ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্মম, নৃশংসভাবে জাতির পিতাকে হত্যার পর আস্তে আস্তে আমরা ধর্মনিরেপেক্ষতা থেকে দূরে সরে যাই এবং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বসানো হয়। এগুলো থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে যে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা ছিল সেগুলো থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। 

৪) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এগুলো ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা। সেই জায়গা থেকেও আমরা এখন অনেক দূরে। এখনো বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। আইনের শাসন এখনো সুদূর পরাহত। এদেশের অনেক গরিব দরিদ্র মানুষ এখনও ন্যায়বিচার বঞ্চিত।

৫) মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি আকাঙ্ক্ষিত বিষয় ছিল নারী পুরুষের সমতা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা অনেকদুর এগিয়েছি কিন্তু এখনও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে নিগৃহীত, নিপীড়িত,নির্যাতিত। এখনও নারীর উপর সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

৬) মুক্তিযুদ্ধে আমাদের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল যে আমরা একটি উন্নত, আধুনিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবো। যদি ’৭৫র ১৫ আগস্ট দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা না ঘটতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশ এতদিনে বিশ্বে একটি উন্নত দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াত। ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনা আমাদের অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে। যদিও এখন আমরা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছি। বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। 

আমরা যদি বিশ্লেষণ করি আমাদের অর্জন এবং ব্যর্থতাগুলো তাহলে নিঃসন্দেহে বলতে পারি, বাংলাদেশে অনেক প্রতিকূলতা অনেক প্রতিবন্ধকতার পরও আমরা যা অর্জন করেছি সেটাই অনেক। বাংলাদেশ যে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার পথে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার পথে এগিয়ে যেতে হলে যেটি দরকার সেটি হলো ধারাবাহিকতা। সেই ধারাবাহিকতাটা আমরা ধরে রাখতে পারব কিনা তা নির্ধারিত হবে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

বাংলা ইনসাইডার/বিকে  



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭