নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 08/01/2019
সম্পর্কের ৬ বছর পার করে বিয়ের পিড়িতে বসেছে নওশাবা আর ভাস্বর। বিয়ে সম্পন্ন করতে তাদের নামতে হয়েছে রীতিমত যুদ্ধে। পরিবারকে ম্যানেজ করতে হয়েছে, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের অবস্থানে শক্ত থেকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। একটা বিয়েতে এত যুদ্ধ কেন? কারণ, দুজন ভিন্ন ধর্মের। আধুনিক এই দম্পতি নিজ ধর্মে থেকেই বিয়েটা সেরেছেন। ভাস্বর তার হিন্দুপ্রথা আর নওশাবা তার মুসলিম প্রথা মেনে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে সংসার। বাধাবিপত্তি এলেও থেমে থাকেনি কিছুই। সমাজ আর পরিবার এই ধরনের বিয়েতে বৈধতা দিতে বরাবরই নারাজ। কিন্তু তাই বলে কি থেমে থাকছে অন্যধর্মের বিয়ে? মোটেও না। ভালোবাসা আর শক্ত সিদ্ধান্তের কাছে ধর্ম বাধা থাকছে না। এজন্য এগিয়ে এসেছে আইনব্যবস্থাও।
আমাদের দেশি বিদেশি অসংখ্য পর্দা কাঁপানো তারকা এই ভালোবাসার টানেই ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করেছেন। আমাদের দেশে সবার আগে আসে স্বনামধন্য তারকা দম্পতি রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদার। নিজ ধর্ম বজায় রেখে এখনও সমান জনপ্রিয় দম্পতি তারা। তাদের একমাত্র সন্তান ত্রপা মজুমদার তার নিজ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত। বাপ্পা মজুমদার-চাঁদনী, শাকিব খান- অপু বিশ্বাস, বৃন্দাবন দাস-শাহনাজ খুশি, বন্যা মির্জা-মানস চৌধুরীসহ অসংখ্য ভিন্নধর্মের দম্পতির কথা আমি জানি। বলিউডেও এই সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়।
নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অটুট রেখে সংসার করছেন অনেক দম্পতি। এটাকে সমাজের অনেক বড় পরিবর্তন বলছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। ধর্ম পরিবর্তন না করেই দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে বিয়ের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। একই ধর্মের দুজন বিয়ে করে ঘর সংসার করতে হবে এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসছেন অনেকেই। দুই ধর্মের দুজন তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস ঠিক রেখে বিয়ে করছেন। আচার-আচরণ পালন করছেন যে যার বিশ্বাসমতোই।
ধর্ম পরিবর্তন করে নিতে চাইলে
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে ১৮৭২ সালের বিশেষ বিয়ে আইন রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বিশেষ বিয়ের জন্য একজন রেজিস্টার থাকে। প্রথমত বৈধ বিয়ে করা হচ্ছে এই হিসেবে এফিডেভিট করতে হয়, নাম ধর্ম পাল্টে পরে রেজিস্টারের কাছে হলফনামা জমা দেয়। এর ১৪ দিন পর একটি নোটিশ দেওয়া হয়। পরে নোটিশ নিয়ে রেজিস্টারের কাছে গেলে বিয়ে নিবন্ধিত করা হয়।
ধর্ম অটুট রেখে কীভাবে বিয়ে সম্ভব
বাংলাদেশের বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ (সংশোধিত ২০০৭) অনুযায়ী এই বিয়ে হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী, একজন মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, ইহুদি বা অন্য কোনো ধর্মের যে কেউ যে কারো সঙ্গে বিয়ে করতে পারবে। ধর্মের পরিবর্তন করা লাগবে না। বা দুজনই ধর্মীয় বিশ্বাস বাদ দিয়ে বিয়ে করতে পারবে। বা একজন অন্যজনের ধর্ম মেনে নিতে পারবে।
ভিন্ন ধর্মের দুইজন যদি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান তবে তাদের বিয়েটি রেজিস্ট্রি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন এলাকায় ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এই ম্যারেজ রেজিস্ট্রারদের অফিসে যেয়ে, নির্ধারিত ফরম পূরণ করে ও সরকার কর্তৃক নির্ধারিত রেজিস্ট্রি ফি পরিশোধ করে বিয়েটি রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আরও প্রয়োজন হবে ৪ কপি পার্সপোর্ট সাইজ ছবি, ৩ জন সাক্ষী, জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি কপি, যদি দুজনের কেউ বাংলাদেশী নাগরিক না হন তবে সে ক্ষেত্রে তার পাসপোর্টের কপি। এই ধরনের বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আর একটি বিশেষ বিষয় হল যে বিয়ের ১৪ দিন আগে একটি নোটিশ দিতে হয়। যেকোনো এক পক্ষ এই নোটিশ প্রদান করলেই চলে। এই নোটিশটি ও মেরেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরন করে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে দিতে হবে যে তারা বিয়ে করতে চান।
কি হচ্ছে উত্তরাধিকারদের
এই অন্য ধর্মে বিয়ের ফলে একেবারে নতুন একটি প্রজন্ম বা উত্তরাধিকার তৈরি হচ্ছে। যারা উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো ধর্মীয় পরিচয় বহন করছেন না। আধুনিক সমাজে সেটা অবশ্য প্রয়োজনও মনে করছেন না অনেকে। এই উত্তরাধিকারদের মধ্যে আবার কেউ কেউ নিজেই একটি ধর্ম বেছে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ধর্ম বিশ্বাস থেকেই সরে আসছেন।
তবে রাষ্ট্র আইন করে এমন বিয়ের ব্যবস্থা করলেও এসব পরিবারের সম্পত্তি বণ্টনের জন্য কোনো আইন নেই। বাংলাদেশে ইসলাম, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মীয় আইনে সম্পত্তি ভাগ হয়। কিন্তু এই পরিবারের সম্পত্তি যদি বাবা-মা ভাগ করে দিয়ে না যান বা উইল না করেন, তবে ভাগ করার কোনো নিয়ম নেই।
এটা তো গেলো আইনগত দিক। বিয়ে তো হয়ে গেলেই তারা হয়ে গেলেন দম্পতি। কিন্তু সমাজকে উপেক্ষা করে সারাজীবন একসঙ্গে কাটানো, বিশাল বড় এক চ্যালেঞ্জ বৈকি। গত কয়েক বছরে এই বিয়ের সংখ্যা বেড়েছে। অনেকে আছেন আবেগে বিয়ে করছেন। কেউ জেনেবুঝে নিজেদের গণ্ডি ভাঙছেন। অনেক পরিবার এই বিয়ে মেনে নিচ্ছেন, অনেকে মানছে না।
কি ধরনের সমস্যা হতে পারে
সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয় তা হলো আরেকটা ধর্মের পরিবারের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া। স্বভাবতই সেই পরিবারটি একেবারেই ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর আচারে অভ্যস্ত। সেখানে অন্যধর্মের কাউকে গ্রহণ করে নিতে একটু সমস্যা হয়ই। তাদের রূচি, খাদ্যাভাসও পুরোপুরি ভিন্নরকমের থাকে।
সমাজ আর পরিবারে অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো, আরেকধর্ম ছেড়ে আসতে হলো কেন- এই প্রশ্ন সবসময়েই আসতে থাকে। এতে বরাবরই বিব্রত হতে হয়।
অনেক সময়ে নাম আর পদবী নিয়েও পড়তে হয় বিপাকে। অন্যধর্মে বিয়ে করে কেন ধর্ম পরিবর্তন হলো না, স্বামীর ধর্ম কেন মেনে চলা হচ্ছে না, নাম আর পদবী কেন আগের মতোই রয়ে গেছে- এগুলো নিয়ে কটূকথা খুব চলতে থাকে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে। সন্তানকে তারা নিজেদের মতো করে পালন করলো ঠিক আছে। কিন্তু সমাজ সেটা শুভদৃষ্টিতে দেখে না। তাদের স্কুল, কলেজে ভর্তি করতে গিয়ে পিতামাতার নাম দেখে তারা বিভ্রান্ত হয়। সন্তানের বিয়েশাদির ক্ষেত্রেও ঘটে বিড়ম্বনা।
কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে পুরোপুরি দুটো মানুষের। যারা পুরো ধর্ম আর সমাজব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে শুধু ভালোবাসা আর একসঙ্গে থাকার খাতিরে এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের সমাজ থেকে উপেক্ষা করা হয়তো উচিৎ না। তারা যদি আইনের আওতায় বিয়েটা করে, একসঙ্গে থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় তবে সেটা সমাজের জন্য আসলেই ক্ষতিকর নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো একসঙ্গে ভালো থাকা। সেটা সম্ভব হলে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা না রাখলেও চলে।
বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭