ইনসাইড থট

দূষণমুক্ত আবাসন সুস্বাস্থ্যের সূতিকাগার!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 10/01/2019


Thumbnail

 

চারিদিকে বাড়ছে দূষণ। সেই দূষণের হাত থেকে রেহাই নেই ঘরের মধ্যে বসবাস করলেও। বাইরের দূষণ নির্দ্বিধায় চলে আসছে শোবার ঘরে, রান্না ঘরে কিংবা বসে থাকার স্থানটিতেও। ঘরকে জীবাণু মুক্ত করার জন্য ব্যবহার করছি অতি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন এসি। খরচ করছি অতিমাত্রায় বিদ্যুৎ। ভুগতে হচ্ছে হরেক রকম স্বাস্থ্যগত সমস্যায়। আর একটি উন্নয়নশীল দেশে ভবিষ্যতে দূষণমুক্ত পরিবেশের অঙ্গিকার হবে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জিং আমাদের জন্য প্রায় সব সেক্টরে। তবে আমরা আমাদের অভ্যাসগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও আমাদের নিজেদের নিজ গৃহ দূষণমুক্ত রাখতে পারি সুস্বাস্থ্যের জন্য। প্রয়োজন সচেতনতার। তবে সাধারণ নগরকেন্দ্রিক মানুষজন কী ভাবছেন এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি একটি জরিপ করা হয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধীনে ‘এনভাইরোমেন্টাল ল্যাব’ এর সহায়তায় বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে। যা এখনো চলমান। জরিপটিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ডঃ মাসা নগুচি। ধারণা করা হচ্ছে জরিপের কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হলে সেটি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রকাশ করা হবে সব ধরনের তথ্য দিয়ে।  

এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা হয়েছে যে, ডাটা সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোন ধরনের নির্ভরতা যেন কাজ না করে। এমনকি ডাটা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বয়সের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। সেক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে কাউকে প্রশ্নপত্র পূরণ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি কাউকে কোন কিছু সম্পর্কে উত্তর কী হবে সেটি বলা হয়নি। সবাইকে উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু কিছু ঘরবাড়ি সম্পর্কিত বিষয়াদি শুধুমাত্র ধারণা দেওয়া হয়েছে, যেন তারা সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারেন। প্রশ্নপত্রেকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে বসবাসকারীদের জন্য আর্থ-সামাজিক বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সকলের বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, চাকরি, এবং কর্মক্ষেত্র নিয়ে জানতে চাওয়া হযেছে। পরবর্তীতে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সর্বমোট পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং তাদের মাসিক আয়-ব্যয় সম্পর্কে তথ্য দিতে বলা হয়েছে। যেহেতু প্রশ্নপত্রে কারো নাম লিখতে হবে না তাই সবাই সঠিকভাবে নির্ভয়ে তাদের তথ্যগুলো দিতে পারবে। এমনকি তারা বর্তমানে যে বাসায় বসবাস করছেন সে স্থানের বর্তমান অবস্থা, বাসা পরিবর্তনের তথ্য, বাসার প্রকারভেদ, নির্মাণ উপকরণ, নির্মাণের সময়কাল এবং কতদিন হলো তারা সে বাসায় বসবাস করছেন সেসব বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রশ্নের বিপরীতে সর্বনিম্ন ৪টি উত্তর দেওয়া হয়েছিল। তাই সবাই তাদের জন্য প্রযোজ্য সঠিক উত্তরে টিক মার্ক দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের কে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এই জরিপের ক্ষেত্রে। কারণ বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিতে শহরকেন্দ্রিক অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করা কিংবা বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করা তাদের জন্য সম্ভবপর বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। প্রশ্নপত্রের ২য় অংশে বসবাসকারীদের তাদের নিজ বাড়ীতে পরিবেশগত স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রশ্নের ধরন নিম্নে বর্ণনা করা হলো:

প্রথম প্রশ্ন ছিলো স্বাস্থ্য সমস্যার প্রকারভেদ নিয়ে, যা পরিবেশগত কারণে অনেক সময় হয়ে থাকে। যেমন সর্দি-কাশি, দুর্বলতা, চুল পড়া, এলার্জি, ডায়াবেটিস, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, মাথা ব্যথা, ব্লাড প্রেশার, চোখের সমস্যা ইত্যাদির উপর। আর যদি উপরোক্ত কোন সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে সেগুলো সাধারণত কখন হয়, কোন স্থানে বেশী হয় যেমন: শোবার ঘরে, বসার ঘরে কিংবা রান্নাঘরে ইত্যাদি। এমনকি দিনের কোন সময় গুলোতে এগুলো বেশী হয় সেটিও জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর পরবর্তী অংশে জানতে চাওয়া হয়েছিল বসবাসের স্থানটির আশপাশের অবস্থা কেমন সেগুলোর উপর। যেমন বসবাসের স্থানের সঙ্গে কোন ময়লা রাখার স্থান কিংবা গাড়ী রাখার স্থান সংযুক্ত আছে কিনা। বাসায় কোন পোষা প্রাণী আছে কিনা কিংবা বাসায় বসবাসরত যে কারো মধ্যে এমন কিছু অভ্যাস আছে কিনা যা ঘরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নষ্ট করতে পারে, এমনকি নোংরা করতে পারে। এমনকি গত তিন মাসের মধ্যে বাসার কার্পেট কিংবা আসবাবপত্রের কোন ধরনের পরিবর্তন হয়েছে কিনা- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে। রান্না ঘরের ক্ষেত্রে জানতে চাওয়া হয়েছে কোন ধরণের চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে, কতক্ষণ রান্না হচ্ছে, রান্না ঘরের বাতাস বাইরে বের করে দেবার জন্য কোন সিস্টেম চালু আছে কিনা? বাড়ীতে প্রায়ই এরোসল ব্যবহার হয় কিনা এবং রুম ভেন্টিলেশন বাড়ীতে থাকলে তার অবস্থান কোথায় কোথায় আছে প্রশ্নপ্রত্রে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল বাড়ীতে কোন সময় কোন ধরণের পরিবেশগত সমস্যার অনুভূতি হয় কিনা যেমন ঠাণ্ডা-গরম লাগা প্রভৃতি এবং সেটি কোন সময়ে। সেক্ষেত্রে ‘এসরে’ কোডের ছয় মাত্রার কমফোর্ট স্কেলকে বিবেচনায় আনা হয়েছে। তাছাড়া ঘরে অবস্থানকালে কোন ধরনের খারাপ গন্ধ অনুভূত হয় কিনা এগুলোও জানতে চাওয়া হয়েছিল। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে কিনা কিংবা ঘরের মধ্যে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা দেখা যায় কিনা বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে গুরুত্ব সহকারে।

সবশেষে জানতে চাওয়া হয়েছে যদি তারা মনে করেন তাদের বসবাসের স্থানটির নকঁশা পরিবর্তন কিংবা অন্য কোন পরিবর্ধন তারা আশা করেন তাহলে সেগুলো কি হতে পারে। কারণ হয়তো এই জরিপে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত নাও থাকতে পারে, তাই তাদের চিন্তা গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই জরিপটি করে যে ধারণা পাওয়া গেল আশা করা যায় সেটি আমাদের শহরকেন্দ্রিক বর্তমান আবাসন গুলোর জন্য মারাত্মকভাবে উপযোগী হবে, বিশেষ করে নতুন ভবন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে নকশা প্রণয়ণের ক্ষেত্রে। জরিপে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রায় সব আবাসনের বসবাসকারীদের মধ্যে বিদ্যমান। সেক্ষেত্রে ঠাণ্ডা লাগা, মাথা ঝিমঝিম করা, দুর্বলতা, একঘেয়েমী, সর্দি-কাশি, চোখের সমস্যা এমনকি ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ সবথেকে বেশী। তাছাড়া অনেকেরই শরীরের স্কিনে (চামড়ায়) অনেক ধরনের ভাইরাস জনিত সমস্যার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। যদিও আমরা স্বীকার করি শুধুমাত্র ঘরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশই এসব রোগের মূল উৎস (কারণ) না। তথাপি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ঘরের অভ্যন্তরীণ সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ বসবাসকারিকে অনেক বেশী সুস্থ রাখতে সক্ষম। তাই আমাদের বর্তমানে কী ধরনের ব্যবস্থাপনা নিলে দূষণযুক্ত পরিবেশ থেকে মুক্ত থাকতে পারবো তার জন্য জনমত যাচাই এর প্রধান লক্ষ্য। সেক্ষেত্রে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষজন মনে করেন তাদের বসবাসের স্থানটির প্রধান সমস্যা পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের (বায়ূ চলাচল) সুবিধা না থাকা। বিশেষ করে ক্রস ভেন্টিলেশন এর অপর্যাপ্ততাকে এক্ষেত্রে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া অনেকেই মনে করেন বসবাসের স্থানে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো না পৌছানোর কারণে স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যা দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে। বিশেষ করে ঘরের ভেতরের স্যাঁতসেঁতে ভাবের কারণে সর্দি-কাশি সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রকোপ ভাবে দেখা দেয় তাদের ধারণা অনুযায়ী। এছাড়াও গৃহ অভ্যন্তরে গাছ রোপন কিংবা ইনডোর প্লান্ট, ছাদেও খোলা জায়গায় গাছ লাগানো, টয়লেটের ভেন্টিলেশনকে সঠিক স্থানে রাখা, বড় বারান্দার ব্যাবহারকে অনেকে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন, যার মাধ্যমে বসবাসের স্থানটিকে স্বাস্থ্যসম্মত রাখা সম্ভব। কারণ মনে রাখতে হবে, সুস্বাস্থ্যই সকল কিছুর মূল।

লেখক: সজল চৌধুরী, শিক্ষক ও পরিবেশ বিষয়ক স্থাপত্য গবেষক স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। 

বাংলা ইনসাইডার/বিকে/এমআর



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭