ইনসাইড থট

জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, ভূমি মন্ত্রী অসহায়!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/01/2019


Thumbnail

দেশের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে জমি অধিগ্রহণ খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জমি অধিগ্রহণ আমাদের এই উপমহাদেশে খুব বড় একটা ইস্যু। অনেকে জানেন যে মাত্র একহাত জমির জন্যেও মার্ডার হয়েছে কয়েকজন। জমির ব্যাপারে কেউ কোন ছাড় দিতে চান না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার জন্য গড়ে ওঠা মানসিকতাই এর মূল কারণ। আমাদের দেশের উন্নয়ন মহাযজ্ঞে ভৌত অবকাঠামোগত দৃশ্যমান প্রকল্পের সংখ্যা অনেক বেশি তাই জমি অধিগ্রহণ সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে একটা বিরাট ভূমিকা রাখে।   

অভিযোগে জানা যায় যে, স্থাবর সম্পত্তি ম্যানুয়াল ১৯৯৭ এর ৫০ অনুচ্ছেদ আর ১৯৮২ সালের এতদসংক্রান্ত অধ্যাদেশের ফলে অধিগ্রহণ করা জমি নিয়ে নানা মামলার জট আর তার প্রতিফলন আসে সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায়। অন্য দিকে সাধারণের মানুষের মধ্যে সরকারের উপর চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয় অধিগ্রহণ করা জমির টাকা পেতে ‘ঘুষ বাণিজ্য’ আর হয়রানির জন্য। আর যে এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয় সেই এলাকার মানুষের সততাকে পুরোপুরি ধ্বংস করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। 

দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেল পথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশপথ তৈরিতে আমাদের মত দেশে সাধারণত জমি অধিগ্রহণ করা হয়ে থাকে। প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের আগে সম্ভাব্য এলাকায় তৃতীয় পক্ষ (আমাদের দেশে সাধারণত এনজিও) দিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা হয়, যে জমি অধিগ্রহণ করা হবে সেখানে কোন স্থাপনা আছে কী না। একনেকে প্রকল্প পাশ হওয়ার সাথে সাথে খবরটি সংশ্লিষ্ট এলাকায় চাউর হয়ে যায়। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীদের মাধ্যমে আর পরে জরিপ কাজে নিযুক্ত এনজিওর কুপরামর্শে রাতারাতি, জমি অধিগ্রহণ করা হবে এমন সব এলাকায়, ফাঁকা জায়গায় রাতারাতি স্থাপনা তৈরি হয়ে যায় বেশী টাকা পাওয়ার আশায়।       

যাই হউক না কেন ক্ষতি পূরণের টাকা পেতে বহু মানুষকে তাদের ঘটি বাটি বেচতে হয়, ঘুষ দিয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা পান না। কেন পান না সে কথা বিস্তারিত না বললে পরিষ্কার হবে না। তবুও বিভিন্ন ধরণের উদাহরণ দিয়ে কিছুটা আভাস দেওয়ার চেষ্টা করা যাতে পারে। যদিও জমি অধিগ্রহণ করা সব এলাকার চিত্র এক না। যাদের পৈত্রিক সম্পত্তি তাঁদের অধিকাংশের জমি মিউটেশন করা থাকে না, টাকার অভাব আর স্বল্প শিক্ষিত এসব সরল মানুষদের সম্পত্তি সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবে। তাই তাঁদের নাম ডিসি অফিসের ভূমি রেকর্ডে থাকে না। আবার বহু জমি বিক্রি হলেও তার নাম জারি বা মিউটেশনে স্থানীয় ইউনিয়ন তহসীল অফিস হয়ে থানা ভূমি অফিস ঘুরে ডিসি অফিসের ভলিউমে নাম ওঠাতে কয়েক বছর লেগে যায়। জমি অধিগ্রহণের পরে ক্ষতিপূরণের টাকার নোটিশ যায় ডিসি অফিসের রেকর্ড বই অনুযায়ী। তাতেই হয় জমজমাট ‘ঘুষ বাণিজ্য’। যারা এসব না দিয়ে তাড়াতাড়ি মিউটেশন করাতে যান, তখন ফাইল নড়ে শম্ভুক গতিতে, টাকা দিলেও স্পিড পায় না। অভিযোগ আছে যে ইউনিয়ন তহসীলদারের নিয়োগকর্তা হচ্ছে ডিসি অফিস। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ডিসি অফিস থকে যে ‘ওহি নাজিল’ হয় তাই তামিল করেন ইউনিয়ন তহসীল অফিস। এমপি মন্ত্রী কারো কথাই তারা শোনেন না, কারণ তাঁদের এসিআর লেখার ক্ষমতা এমপি মন্ত্রী কারো নেই। হাতে নাতে ধরা পড়ার পরেও একজন ছোট্ট কর্মচারীর চাকরী খাওয়া তো দূরে থাক তাঁকে বদলিও করতে পারেন না এমন কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী।                       

২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের খবর ছিল ‘চট্টগ্রাম জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের (এলএ) শাখায় ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ রোববার দুপুরে আকস্মিক পরিদর্শনে যান (বর্তমান ভূমি মন্ত্রী) তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। সেখানে কয়েকজন সেবাগ্রহিতা তাঁর কাছে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেন। মন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি অভিযোগ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কার্যালয়ের তিন কর্মচারীকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন তিনি।   

ভূমি মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে মনছুর আলী নামের এক সেবাগ্রহিতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই অফিসে টাকা ছাড়া ফাইল নড়ে না। আমি এক বছর ধরে ঘুরছি আমার জমি অধিগ্রহণের টাকার জন্য’। ওমর উল্লাহ নামের আরেক সেবাগ্রহিতা প্রতিমন্ত্রীকে বলেন, ‘ঘুষ ছাড়া এখানে ফাইল নড়ে না।’ এরপর একে একে আরও আট-নয়জন মন্ত্রীর কাছে সেবা পেতে তাঁদের ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরেন। ভূমি অধিগ্রহণ কার্যালয়ের কর্মচারী আহমদ করিম, নজরুল ইসলাম, মো. হানিফ এবং সার্ভেয়ার সৈকত চাকমা ও মো. মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ সেবাগ্রহিতা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। তাঁদের প্রধান অভিযোগ ছিল, ভূমি অধিগ্রহণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ যে টাকা পান, সেই টাকা ছাড় করাতে কমিশন নেওয়া হয়।

পরে কার্যালয়ের তিন শিকলবাহক (চেইনম্যান) আহমদ করিম, নজরুল ইসলাম ও মো. হানিফকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দেন মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। মৌখিকভাবে সতর্ক করেন সার্ভেয়ার সৈকত চাকমা ও মো. মোবারক হোসেনকে। এছাড়া রফিক আহমদ নামের এক দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তির নির্দেশ দেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত রফিককে এক হাজার টাকা জরিমানা করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দেন।’

পরে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আহমদ করিমকে কয়েক দিন আগে বদলি করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। এখন করিমসহ তিনজনকে তাৎক্ষণিক বদলির নির্দেশ দিয়েছি’।

পত্রিকায় প্রকাশিত ২০১৭ সালের আরেকটি খবরে বলা হয় যে, ‘ঢাকার নর্দারটেকের (বর্তমান উত্তরার সাত নম্বর সেক্টর) আদি বাসিন্দা মোহর আলী ২০০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। উত্তরা মডেল টাউনের ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের বেশির ভাগ বাড়িঘর গড়ে উঠেছে সেই জমির ওপর। অথচ ঢাকা শহরে বসবাসের জন্য এক টুকরা জমি পর্যন্ত মেহের আলীর পরিবারের জোটেনি। পাকিস্তান আমলে তাদের এ বিপুল জমি অধিগ্রহণ হলেও দীর্ঘ ৫০ বছরেও ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি পরিবারটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহর আলীর পরিবারের সদস্যরা এখন অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন যাপন করছে। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার আন্ধারমানিক নামে অজপাড়াগাঁয়ে এক টুকরা জমিতে আশ্রয় নিয়েছে তারা। টাকার অভাবে এ পরিবারের অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। মোহর আলীর নাতি মো. খুরশীদ আলম উত্তরার আজমপুরে সাইনবোর্ড লিখে জীবন ধারণ করতেন। কিছু দিন আগে তিনিও ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।’    

আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছেন। তাই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে র্নীতির দমনে সবার আগে প্রয়োজন দেশের বিদ্যমান আইনের সংশোধন যেমনটি করেছিলো ভারত সরকার ২০১৩ সালে। দিল্লী মেট্রো ৩য় পর্যায় বাস্তবায়নে অনেক দেরি হওয়ার কারণে সংসদে জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩ পাশ করা হয়। আমাদের দেশে তা কীভাবে ভূমি অধিগ্রহণ আইন সহজ করা যায় তা এখুনি ভাবতে হবে। উন্নয়নের ট্রেনে চেপে বসা বাংলাদেশকে পিছু টেনে রাখতে চায় অনেকেই। কারণ বিদ্যমান আইনে তাদের অনেকের, বিশেষ করে সরকারী চাকুরেদের ক্ষমতা অপরিসীম। রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ (রিভাইজড ২০১২) আর সচিবালয় নির্দেশিকা ২০১৪ তে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা খুব জরুরী। যাতে মন্ত্রী আর সচিবদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আসে। সচিব একাই মন্ত্রণালয়ের একাউন্টিং চিফ আবার প্রশাসনিক প্রধান। এতে সচিব হয়ে পড়েন দায়িত্ব ভারাক্রান্ত। সচিবের দায়িত্বভার কিছুটা কমিয়ে কিছু ক্ষমতা মন্ত্রীদের হাতে দেওয়া দরকার। তা না হলে জনগণের চাহিদা মোতাবেক কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বা দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। জনগণের চাহিদা বুঝতে জনপ্রতিনিধির মত লাগবে, কারণ তারা জনগণের সাথে থাকেন।

বাংলা ইনসাইডার/এমআর



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭