ইনসাইড আর্টিকেল

স্বপ্নপূরণ থেকে অনুপ্রেরণার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 23/01/2019


Thumbnail

 

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তার স্বপ্ন। এই স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকে বলেই আমরা বেঁচে থাকি। হাজারো বাধা আর প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে এগোনো যায় যদি স্বপ্ন আর লক্ষ্য অটুট থাকে। সেই সঙ্গে কঠোর অধ্যবসায় স্বপ্নের অনেক কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে। তেমনই এক হার না মানা দৃঢ়প্রত্যয়ী মেয়ের গল্প আজ শুনবো আমরা। 

পরিবার আর সমাজের চাপ-তাড়নায় ১৩/১৪ বছর বয়সে এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হতে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েটি কিন্তু অসম্ভব মেধাবী ছিল। স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা শেষ করার। চোখে টলমল পানি নিয়েই বিয়ের পিড়িতে বসা, শ্বশুর বাড়িতে আসা মানেই স্বপ্নকে বিসর্জন দেওয়া। কারণ সেই শ্বশুরবাড়ির কেউই পড়াশুনার সমর্থন দেয়নি তাকে। বলছিলাম অদম্য সংগ্রামী জ্যোতির (ছদ্মনাম) কথা।

একরকম জোর করে স্বামীকে রাজি করানো গেল। শ্বশুরবাড়িতে বসেই এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকলো জ্যোতি । এদিক-সেদিক থেকে বইপত্র জোগাড় করে ফেললো সে। সারাদিনের কাজ শেষ করে রাতে কিছু সময়ের জন্য পড়তে বসতে হতো। এভাবে চলতে চলতে সেই শ্বশুরবাড়ির কেউ একজন সেই বইপত্র পুড়িযে ফেলে স্বপ্নকে মেরে ফেলতে চাইলো।

কিন্তু স্বপ্ন থেমে যাওয়া এত সহজ নয়। এরপরের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। সামান্য বেতনে চাকরিজীবী স্বামীর নিজেরই থাকার কোনো জায়গা ছিল না, থাকতেন বোনের বাসায়। স্ত্রীকে শহরে এনে যে পড়াশুনা করাবেন, সেই সামর্থ্যও তার ছিল না। কিন্তু ননদ তাকে নিজের বাসায় রেখে পড়াতে একেবারেই নারাজ। কিন্তু জ্যোতির প্রবল জেদের কারণে স্বামী তাকে শহরে নিয়ে এলো, উঠতে হলো কোনো এক বস্তিতে। শহরের নামকরা কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীণ হয়ে স্বপ্নপূরণের প্রথম সিড়িতে উঠে গেলো জ্যোতি।

কিন্তু পথটা তো মসৃণ ছিল না। স্বামীর একার অপর্যাপ্ত আয়ে সংসার আর পড়াশুনা চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। জ্যোতি হাত গুটিয়ে বসে না থেকে খুব সামান্য টাকার টিউশনি জোগাড় করে ফেললো। দুজনের সামান্য আয়েই ভাঙাচোরা খাট, টেবিল চেয়ার নিয়ে শুরু হলো তাদের নতুন এক সংগ্রামের সংসার। একেবারে ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, উঠে রান্নাবান্না করা, ৪ কি.মি. হেঁটে দুইবার বাস বদলে কলেজ যাওয়া। আবার সেই লম্বা পথ পেরিয়ে ফেরা। সংসারে কাজ, রান্না, টিউশনি কিছুই থেমে থাকেনি জ্যোতির। এরই মধ্যে পড়াশুনা চলেছে। অন্তসত্ত্বা হওয়ার পরেও থেমে থাকেনি যুদ্ধ। খুব অসুস্থ হয়েও এইচএসসি পরীক্ষায় বসা অনেকটা অসম্ভব হলেও সে পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষায় ভালো ফলাফলও এসেছে।

এরপর আবার নতুন পথচলা। পরীক্ষার পর কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়াতে হয়েছে জ্যোতিকে। এরপরেও নিজেকে সাবলম্বী করার পথে কোনো বাধা আসতে দেননি। বান্ধবীর মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরম জোগাড় করে ফেললেন তিনি। সেখানে ভালোভাবে উত্তীর্ণও হয়ে গেলেন, সুযোগ মিললো অর্থনীতির মতো বিষয়ে পড়াশুনা করার। সেই শুরুতেই জন্ম নেয় প্রথম সন্তানের। সেই ছোট্ট ৫দিন বয়সী ছেলেকে রেখে দিতে হলো প্রথম ইনকোর্স পরীক্ষা। কিন্তু ছোট সন্তানকে একা রেখে প্রতিদিনের ক্লাস করতে যাওয়া তার জন্য অসম্ভব মনে হতে থাকলো। ছেলেকে আশেপাশের বাসায় রেখে বাধ্যতামূলক ক্লাস করে বাড়ি ফিরতে হতো, সব কাজ সেরে টিউশনিতে যেতে হতো। এভাবে শেষ হলো অনার্স জীবনটা। অনার্সের ফলাফলও ভালো হলো, স্কলারশীপের সুযোগও মিলে গেলো। একটা স্কুলে চাকরি আর মাস্টার্সের পড়াশুনা চলতে লাগলো।

এরপরেই আসতে লাগলো একের পর এক সাফল্য। মাস্টার্স শেষ হতে না হতেই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকতা এবং সরকারি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরির সুযোগ পেলেন জ্যোতি। এরই মাঝে সংসারে এলো দ্বিতীয় সন্তান। সবমিলিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েও সফলতা মিললো- বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি। দারুণ সুনামের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি), প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে চাকরি শেষে এখন তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নি:সন্দেহে দেশের একটি বিশাল দায়িত্ব এখন তার কাধে।

এখনো জ্যোতির চেষ্টা থেমে নেই। এত বড় পদে আসীন থাকা অবস্থায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন তিনি। দুইবছর আগে এলএলবি ডিগ্রিও লাভ করেছেন। শুধু দাপ্তরিক কাজেই নয়, মাঠ পর্যায়ে দরিদ্র, অসহায়, অবহেলিত মানুষের জন্য বিশেষত নারী উন্নয়ন, নারী নির্যাতনের প্রতিকার, ইভটিজিং, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছেন এখনো।

কাজের এতসব স্বীকৃতির কারণে দেশে ‘আয়রন লেডি’র খেতাব পেয়েছেন জ্যোতি। দরিদ্র অসহায় মানুষ ও নারী কল্যাণে কাজ করার জন্য দুটি ফাউন্ডেশন আর মহিলা উন্নয়ন সংস্থা চালাচ্ছেন তিনি। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন এবং সাধারণ মানুষের জীবন মানের পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এভাবেই সারাজীবন সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করার স্বপ্ন তাঁর।

গল্পগুলো শুনলে হয়ত মনে হবে সাজানো কোনো গল্প বললাম এতক্ষণ। কিন্তু এটা বাস্তব জীবনের কথা। মনোবল না ভেঙে উঠে আসার একটি অদ্ভুত সংগ্রামী গল্প। তিনি আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক। জ্যোতি তার নামের প্রতি সুবিচার করেই সবার মাঝে আজীবন জ্বলজ্বল করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।

 

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭