ইনসাইড থট

গ্রামোন্নয়ন ও ‘প্রধানমন্ত্রী’র ভাবনাগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/02/2019


Thumbnail

টেকসই গ্রাম উন্নয়ন নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলো সহ অন্যান্য পত্রপত্রিকায় আমি বেশ কিছু লেখা লিখেছি এবং গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টেকসই গ্রাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং সুদূরপ্রসারি চিন্তাভাবনা আছে যা বাংলাদেশের গ্রামগুলোর টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বেশ কিছুদিন আগে লিখেছিলাম “আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও একটি ভ্যানযাত্রা” শিরোনামে একটি কলাম। লেখাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হাস্যেজ্বল মুখে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা - গোপালগঞ্জের রাস্তায় রিকশাভ্যানে চড়ে গ্রামে ঘুরছেন, সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও তার স্ত্রী সন্তানেরা - ছবিটি আমাদের অনেক আশার কথা বলে দিয়েছিল -আন্দোলিত করেছিল বৈকি! লিখেছিলাম এমনটি এবারই প্রথম নয়, এর আগেও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাধারন জীবন যাপনের উদাহরন সৃষ্টি করেছেন বহুবার, ছোটদের সাথে সময় কাটানো থেকে শুরু করে - নিজের হাতে রান্না - যা দেখলে আমার মতো বাংলার সাধারন মানুষ কিছু সময়ের জন্য হলেও অনুপ্রাণিত হয়, তাদের বুকে আঁশার সঞ্চার হয়, শুধুমাত্র এই ভেবে যে, তারাও আমাদের মতো অতি সাধারন এ দেশেরই নাগরিক, আমাদের মতো তাদের ও সুঃখ দুঃখের অনুভূতি আছে, হয়তো জানি না, আমার মতো অন্যদের ও এমন ছবি দেখে অনেক আপন বলে মনে হয় তাদের, যেন উনারা আমাদের খুব কাছেই আছেন। গ্রামে তার ঘুরে বেড়ানো, গ্রাম নিয়ে তার ভাবনা আর শৈশব গুলো আমাদের আন্দোলিত করে, যা আমরা পাই তার লেখার মধ্যে। “স্মৃতির দখিন দুয়ার - দুই প্রবন্ধে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার শৈশবের গ্রাম বাংলার ছবি। তিনি বলেছেন টুঙ্গিপাড়ার পাশ দিয়ে কুল কুল ছন্দে ঢেউ তুলে বয়ে চলা বাইগার নদীটির কথা। যদি কখনো দিনের আলোয় রোদ ছড়ায় কিংবা তারা ঝরা কোন এক রাতে সেই নদীর পানি তার ভাষায় ছিল রুপোর মতো চকচকে। আজও যখন আমরা কোন এক তারা ঝরা মধ্যরাতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সৌতসীনি কোন নদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকি ঠিক যেন সেই মায়াময় দৃশ্যই আমাদের চোখে ধরা দেবে। নদীর পাড় ঘেঁষে কাশঁবন, আখের ক্ষেত, সারি সারি খেঁজুর গাছ, বাশবাগানের ঝার, কিংবা বুনো লতা পাতার জংলা সবকিছুই যেন ছিল তার চিন্তায় চিরচেনা শৈশবে। এমন করে খুব আবেগ দিয়ে তিনি যেন গ্রামকে একেছেন কোন এক অচেনা শিল্পীর চিরচেনা রং তুলিতে। সেখানে খেলা করে শালিক - চড়ই, ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘূর কুঁহ কুঁহ ডাক তাকে ফেলে দিত এক নিমগ্নে। তাইতো তিনি গ্রামকে ভালোবেসে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন “আমার জীবনের শেষ দিনগুলো আমি টুঙ্গিপাড়ায় স্থায়ী ভাবে কাঁটাতে চাই। খুব ইচ্ছে আছে নদীর ধারে একটি ঘর তৈরী করার ।” যদিও জানা নেই সেই ঘরের স্বরুপ কেমন হবে - তবে তার লেখার মধ্যে দিয়ে তারও কিছুটা আঁভাস পাওয়া যায়, সেই ঘর হবে খুব সাধারন, থাকবে মাটির দেওয়াল, বাঁশ-লতা দিয়ে মোড়ানো - ছোট্ট একটি উঠোন, সামনে বয়ে যাবে নদী। এখানে এটা উল্লেখ্য যে, তাঁদের পূর্বপুরুষ যখন টুঙ্গিপাড়াতে জমি জমা ক্রয় করেন তখন সেখানে কলকাতা থেকে কারিগর এবং মিস্ত্রী নিয়ে সেখানে দালান তৈরী করেন, যা পরবর্তীতে পাক হানাদার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। যার ধ্বংসাবশেষ এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছেলেবেলা ছিল অত্যন্ত মধুর তার সবটুকুই যেন গ্রামের স্মৃতি। গ্রামের পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, ধুঁলোমাখা মেঠোপথে ধুঁলো মেখে বাড়ি ফিরে বকুনি খাওয়া কিংবা কোন কোন সময় বাবুই আর চড়ই পাখির বাসা তৈরীর কারসাজি দেখে দিন কাটতো। শৈশবের তার সমস্ত স্মৃতি জুড়েই রয়েছে গ্রামের সহজ-সরল প্রকৃতি আর পরিবেশ। পাখিদের সাথে মিলেমিশে কাটানো শৈশব, তাদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা যেন বারে বারে উঠে আসে তার কথায় তার লেখায়। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের জীবন তাকে ভাবতে শিখাতো। সেই সময় গ্রামের ঘরবাড়ি গুলো ছিল সব কিছুর আঁধার। দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরী হতো। বাগানের ফল আর পুকুরের তাজা মাছ ছিল রোজকার বিষয়। গ্রামের কথা বলতেই যেন এগুলোই আমাদের মনে ভেসে আসে। কাচারি ঘরের ব্যাবহার ছিল তাদের জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে। গ্রামের বড় বড় সবুজ মাঠে ঘুরে বেড়ানো আর বন্ধুদের সাথে নিয়ে খেলায় মত্ত হওয়া এ যেন জীবনের সাথে একই সুত্রে গাঁথা ছিল। এমনকি ফড়িং এর পেছন পেছন দৌড়ানো আর ঝরে পড়া পাতা গুলোকে কুড়িয়ে কোথাও- কোন বারান্দায় গুছিয়ে রাখার স্মৃতিগুলো ছিল বড়ই আদরের। আর এভাবেই গ্রামের সাথে নিজেকে মিলিয়ে সবুজ বাংলার গ্রামের ছবি এঁকেছেন তিনি। আর তাঁর সেই স্মৃতিগুলোর সাথে পথ চলতে চলতে আমরা দেখা পাই সবুজ শ্যামলে ভরপুর বাংলার অপরুপ গ্রামের চিরায়িত প্রতিচ্ছবি। তাইতো তিনি বলেছেন “গ্রামের ছায়ায় ঘেরা, মায়ায় ভরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং সরল সাধারন জীবনের মাধুর্যের মধ্য দিয়ে আমি বড় হয়ে উঠি”- আর দিন শেষে আমরা পাই একজন ‘দেশনেত্রী- জননেত্রী’। তিনি আরো বলেছেন “আমার শৈশবের স্বপ্ন রঙিন দিনগুলো কেঁটেছে গ্রাম বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রান নিয়ে, জোনাক জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে. তাল-তমালের ঝোঁপে বৈচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলো মাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।” আর এগুলো মিলেই তো আসলে পরিপূর্ণ একটি গ্রাম। সবুজ একটি গ্রাম, যার পরতে পরতে থাকা অনেক কথা, অনেক আবেগ আর স্থাপত্যের মিলবন্ধন। আজকালকার শহুরে ব্যাস্ত জীবনে আমরা কজনই বা পারি কলাগাছ ফেলে সাঁতার কাঁটতে, শীতের দিনে নদীর উষœ পানিতে পা ভিজাতে, কিংবা গামছা বিছিয়ে টেংরা পুটি আর খল্লা মাছ ধরা! আমরা যখন গল্প শুনি বৈশাখের কাঁচা আম পেড়ে কুচি কুচি করে কেটে সর্ষেবাঁটা ও কাচা মরিচ মাখিয়ে- কলাপাতায় আমমাখা পুরে, তার রস টেনে খাওয়ার মতো আবেগি স্মৃতি-সত্যই তখন একরাশ শিহরন বয়ে যায় আমাদের ধমনীতে। কারন কিভাবে টিল দিয়ে আম পাড়তে হয়, বরই গাছে ঝাঁকুনি দিতে হয় - তার সবটাই তো আজ অচেনা আমাদের এই শহর জীবনে। পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে ছোট্র ডিঙিতে ঘুরে বেড়ানো সে তো শুধূ গ্রামেই সম্ভব। সেই নৌকার জানালার ধারে বসে দূরের সবুজে ঘেরা গ্রাম যে আমরাও দেখতে চাই। তবে একথা সত্যি সময়ের পরিক্রময়ায় আর সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞানের আর্শীবাদকে আজ আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পরিবর্তনের সাথে আমাদেরকেও তাল মেলাতে হবে। ব্যাবহার করতে হবে আধুনিক প্রযুক্তিকে। দুর্গা ও অপুর গ্রাম হয়তো আজ আমরা ইচ্ছে করলেই পাবো না। তবে এই বাংলার গ্রামগুলোই টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে - আমাদের সরলতাকে। গ্রামীণ অর্থনীতির ভীত শক্ত না হলে শহরের খুটিও শক্ত হবে না, একথা ভুলে গেলে চলবে না। তাই দিন বদলের হাওয়ায় গ্রাম উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি মাত্র। এ বিষয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি আমাদের মানণীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকারকে। কারন “সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ” এই স্লোগানের উপর ভিত্তি করে নবনির্বাচিত সরকারের নির্বাচনী ইসতেহার ২০১৮ তে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর আধুনিকায়ন নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা। নিঃসন্দেহে গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আশা জাগানিয়া প্রতিশ্রুতি-একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সবথেকে প্রধান ও ইতিবাচক হলো, উন্নয়ন চিন্তার মধ্যে সর্বপ্রথম আমাদের গ্রামকে স্থান দেওয়া। নাগরিক আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক অধিকার গ্রামেও নিশ্চিতি করা। আর গ্রাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক আগেই তার ‘স্মৃতির দখিন দুয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন সুষ্ঠ বিদ্যুতায়ন ব্যাবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল - কলেজ, মাতৃসদন, কৃষি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খেলার মাঠ, প্রশস্ত রাস্তা ঘাট, মজবুত ঘরবাড়ি প্রভৃতির কথা। চেয়েছেন কৃষিতে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিব্যাবস্থার কথা, উৎপন্ন দ্রব্যের সুষম বন্টনের কথা, নির্ধারিত মূল্যে বাজারজাতের কথা। করতে চেয়েছেন সুষ্ঠু খাদ্য সংরক্ষন ব্যাবস্থাপনা এবং কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাবহারের নিশ্চয়তা। সেই সাথে নদ-নদী, খাল-বিলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, গবাদিপশু ও হাস-মুরগির ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে খামার তৈরী, সর্বপরি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কুটির শিল্পের মানোন্নয়ন এবং শিল্পের বিকাশ। বাড়াতে চেয়েছেন কর্মসংস্থান। ধর্মীয় গোড়ামি আর কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করেছেন তিনি। মেয়েদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে পথ চলার শক্তির কথা বলেছেন তিনি। শিশুদের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন “গ্রামের উন্নতিকল্পে আরও একটি বিষয় আমাকে ভীষণভাবে আতঙ্কিত করে তোলে। সেটা হলো, আমাদের সবচেয়ে অবহেলিত অসহায় অংশ পুষ্টিহীন কংকালসার শিশুর সংখ্যাধিক্য। দেশের সর্বত্র আমি যে গ্রামেই গিয়েছি এই একই চেহারার শিশুদের দেখেছি। এসব শিশু যখন জন্ম নিচ্ছে তখন অবশ্যই তাদের ভবিষ্যৎকে সম্ভাবনাময় ও নিরাপত্তাপূর্ণ করে তুলতে হবে। তাদের শৈশব কৈশোর ও যৌবনকে আনন্দময় ও সুখময় করে তোলার উদ্যোগ আমাদেরকেই নিতে হবে।” তার মতে সাময়িক কোন ব্যাবস্থাপনা নয় বরং প্রয়োজন “সামগ্রিক উন্নয়ন” যার জন্য তিনি কাধে কাধ মিলিয়ে দেশের শিক্ষিত তরুন সমাজকে কাজে নামতে বলেছেন - তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। আমরাও আজ অনেক আশাবাদী। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী সবুজ বাংলার গ্রামকে তার বুঁকে ধারন করেন সবসময়, যার স্মুতিতে রয়েছে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে ক্ষেত - খামারে অসংখ্য বিচিত্র জীবনের চরিত্র - গল্প, তার হাত ধরে বাংলার গ্রামগুলো আবার ফিরে পাবে সবুজ প্রাণ - হয়ে উঠবে আরো কর্মচঞ্চল, আরো রঙিন। পরিকল্পনাহীনতায় গ্রামগুলো কোন ভাবেই নষ্ট হবে না। সবশেষে তার কথা দিয়েই শেষ করছি “জীবনানন্দের রুপসী বাংলা যেন আমার গ্রাম-এর চেয়ে আর কোন আকর্ষণ, মোহ, তৃপ্তি আর কোন কিছুতেই নেই আমার। ধূলি-ধূসরিত গ্রামের জীবন আমার আজন্মের ভালোবাসা। আমার হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি।” আর আমরাও প্রতিক্ষায় আছি পরিকল্পিত গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে।


সজল চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক
স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,চট্টগ্রাম।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭