ইনসাইড আর্টিকেল

একুশের স্মৃতি: ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 02/02/2019


Thumbnail

মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। পৃথিবীর সমস্ত ভাষাভাষী মানুষই নিজের ভাষায় কথা বলবে, এটিই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু ভাষার ওপর আঘাত অর্থাৎ একটি ভাষাভাষীর মানুষের ওপর অন্য একটি কৃত্রিম ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। আর এই বিরল ঘটনা ঘটেছিল ভারত উপমহাদেশের একটি জাতি- যারা রাজনৈতিকভাবে পরাধীন কিন্তু সহস্র বছরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যাদের গর্ব অপরিসীম, সেই বাঙালি জাতির ওপর। ২০০ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাবার সময় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশকে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত করে যায়। একটি ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। ভারত রাষ্ট্রটি হলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে আর পাকিস্তান হলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে। কিন্তু উপমহাদেশের তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষ ধর্মীয়ভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জাতিতে ছিল বাঙালি। আর পূর্ব বাংলার অবস্থান ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে ১২০০ মাইল দূরে বিচ্ছিন্ন পূর্বের একটি জনপদ। পূর্ব বাংলাকে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখনই এই জনপদের মানুষ আরও একটি পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে যায়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিম অংশের তুলনায় পূর্ব অংশের মানুষ সংখ্যায় ছিল বেশি এবং এদের ভাষা ছিল বাংলা। আর পশ্চিম অংশের সংখ্যালঘিষ্ঠদের ছিল কয়েকটি ভাষা- পাঞ্জাবি, সিন্ধি, ৰেলচি পশতু। এই ভাষাসমূহের সঙ্গে স্বাধীন পাকিস্তানে আরও একটি ভাষা যুক্ত হয়, যার নাম ‘উর্দু’। এই ভাষাটি পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের ভাষা নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর ভারতীয় একটি অঞ্চলের কিছু মানুষ (যারা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান) পাকিস্তানে চলে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে তাদের মুখের ভাষা উর্দু। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার শীর্ষস্থানে থাকা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা করার হীন প্রস্তাব ও পায়তারা শুরু করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা এবং অন্যান্য ভাষাভাষীদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে ও চাপিয়ে দেওয়া একদিকে মৌলিক অধিকার খর্ব করা, অন্যদিকে ভাষা নিয়ে জনগণের সঙ্গে একটি ষড়যন্ত্রের শামিল। তাই বাংলা ভাষার ওপর কুঠারাঘাত বাঙালিমাত্রই মেনে নেননি, নিতে পারেননি। শীর্ষ বাঙালিরা, যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আবদুল হক, অধ্যাপক আবুল কাশেম প্রমুখ যার যার অবস্থান থেকে তীব্র সুরে প্রতিবাদ জানালেন। শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রায় প্রত্যেকেই বাংলা ভাষার মর্যাদার পক্ষে। সুচিন্তিত, সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত যুক্তি ও মতামত প্রদান করলেন। কিন্তু এদের কথা, যুক্তি ও মতামতকে পাশ কাটিয়ে অগণতান্ত্রিক এবং অযৌক্তিকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দুঃসাহস দেখালেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরা। ’৪৭ গেল, ’৪৮ সালে স্বয়ং জিন্নাহ ঢাকায়। এসে ঘোষণা দিয়ে বললেন, `উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা`। জিন্নাহর এই ঘোষণার পর ছাত্ররাই প্রথম ‘না, না’ ধ্বনি তুলে প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহ প্রথম ঘোষণা দেন ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনায় এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে। ফলে সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ তার প্রস্তাবের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাসহ সারা দেশে। প্রতিবাদ কিছুদিন স্তিমিত থাকে। পরে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিটি তীব্র হয় এবং আন্দোলনে রূপ নেয়। যদিও বিগত চার বছরের মধ্যে জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হন।

নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনিও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায় অনড় থাকেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের স্কুল-কলেজগুলোর প্রতিবাদমুখর ছাত্রসমাজ সংগঠিত ও সাহসী কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে। ছাত্র ও আন্দোলনরত ভাষাকর্মীদের ধর্মঘট ও অন্যান্য কর্মসূচিকে বানচাল করার নিমিত্তে পুলিশ বাহিনী ঘূণ্যভাবে নির্যাতন ও অত্যাচার শুরু করে। অনেক ভাষাকর্মীকে তারা গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করে। কিন্তু আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। দিন আসে চূড়ান্ত বিজয়ের । প্রায় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে যে প্রতিবাদ দানা বাঁধে সেটিই বিস্ফোরিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারিতে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নিলে সরকারি বাহিনী অন্যায্য ও ঘৃণ্যভাবে ঝাপিয়ে পড়ে ভাষাকর্মীদের ওপর। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে তারা গুলি চালায়। গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হন কয়েকজন তরুণ ভাষাকর্মী- রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত প্রমুখ। ভাষাকর্মীদের রক্ত বিফলে গেল না। তারা জীবন দিয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে গেলো। আর তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ সারা দেশে তৈরি হতে থাকোলো স্মৃতিস্তম্ভ- শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার আমাদের প্রাণের মিনার। এই মিনার, ভাষা শহীদদের স্মৃতি ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে ধারণ করতে  অর্ধশতক পর একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হচ্ছে - এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ বলে মনে করি। আমাদের আরও প্রত্যাশা এই অ্যালবাম শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বেই প্রশংসা কুড়াবে। কারণ বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে।

লেখাটি সি এম তারেক রেজার  ‘একুশ: ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস (১৯৪৭-১৯৫৬)’ বই থেকে সংকলিত হয়েছে।

‘১৯৫২ সালে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন `রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই` এই দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ধুবালীয়ায়। তার বাবার নাম আব্দুল জলিল। তিনি একজন কৃষক ছিলেন। মায়ের নাম আমেনা খাতুন। ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর সাতাশি বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত অসুস্থতায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।’

 

বাংলা ইনসাইডার 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭