নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 05/02/2019
পকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ববাংলায়, আজকের বাংলাদেশ নতুন চেতনা ও দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন দানা বেধে ওঠে। সচেতন ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ঐতিহাসিকগণ নতুন আলোতে বিগত দিনের আন্দোলন ও অগ্রগতির ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। শাসক মুসলিম লীগ বিরোধী নয়া রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে বিরোধী শক্তির উথান। ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত মূলনীতি সম্পর্কে আন্দোলনধর্মী অভিমত, বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ এবং একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আজকের দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের মূল্যবান অধ্যায়।
গত পঁয়তাল্লিশ বছরব্যাপী ভাষা আন্দোলন ও রাজনীতি ক্ষেত্রে তার প্রভাবের প্রকৃত মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের ইতিহাসের এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র অধ্যায় সম্পর্কে প্রতিটি নাগরিক সচেতন ও শ্রদ্ধাবান। মহান একুশে ফেব্রুয়ারির মতো জাতীয় ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার অবতারণা স্বাভাবিক। কিন্তু এই জাতীয় ব্যাপক আন্দোলন, যা প্রতিটি বাংলাদেশবাসীকে স্পর্শ করেছে, তার পশ্চাতে প্রবহমান ঘটনার মধ্যে এমন সমস্ত কর্মকাণ্ড থাকতে পারে, যার প্রচেষ্টা একান্তই অনুল্লেখযোগ্য নয়। শহীদের রক্ত যেন প্রতিটি নাগরিককে এক অবিশ্বাস্য প্রতিজ্ঞায় লৌহ দৃঢ় সৈনিকে পরিণত করে তুলেছিল। আর এই আন্দোলন ও জীবনদানকে সার্থক করে তোলার জন্য বহুজন বহুক্ষেত্রে অনুরুদ্ধ না হয়েও ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। তাদের সেই প্রচেষ্টার ঐতিহাসিক মূল্য হয়তো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
দুদল যুবক এমনি ধরনের উদ্যোগ নিয়ে হত্যা, গুলি, ব্যাপক গ্রেফতার, ১৪৪ ধারা ও কারফিউর মধ্যেও ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে দুটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে নির্যাতন ও প্রতিরোধের কাহিনী জনসাধারণের মধ্যে বিলি করেছিলেন। এ দু`গ্রুপের কর্মস্থল ছিল বাংলা বাজারস্থ ‘দিলরুবা` পত্রিকার অফিস এবং পাটুয়াটুলিস্থ রমাকান্ত নন্দী লেনের ‘পাইওনিয়ার প্রেস`।
২২ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ অঙ্গন ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত শার্ট নিয়ে ছাত্র-জনতার এক বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলটি কার্জন হলের সম্মুখ দিয়ে এসে আবদুল গনি রোড ধরে অগ্রসর হতে চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের ব্যারিকেড মিছিলটিকে ফজলুল হক হলের পাশ দিয়ে সিদ্দিক বাজারমুখী হতে বাধ্য করেছিল। মিছিলের অগ্রভাগ পুরানো শহরের দিকে কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পরই সশস্ত্র পুলিশ ও নিয়েজিত সেনাদল শ্লোগান মুখরিত মিছিলটির মধ্য ভাগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণে মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ হতে বাধ্য হয়। তারপর থেকে ১৪৪-ধারা ভঙ্গ করে জনতা শহরের সর্বত্র খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল বের করতে থাকে। এই নিদারুণ পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে যারা আহত হন, তাদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু গ্রেফতারের আশঙ্কায় অনেকেই হাতপাতালে রাত্রি কাটাননি।
সেদিন সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান শহীদ হন। ‘নিশাত’ সিনেমার সম্মুখস্থ ‘সংবাদ’ অফিস আক্রমণ করার জন্য বিক্ষুব্ধ জনতা বংশাল-নবাবপুর রোডের মোড়ে পৌছালে চলন্ত ট্রাক থেকে মিলিটারি গুলিবর্ষণ করে। এখানে ও সদরঘাটে বেয়নেট চার্জ করা হয়। মিছিলকারী জনতা জনসন রোডস্থ ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার মুদ্রাকর ‘জুবিলী প্রেস’ পুড়িয়ে দেয় এবং বিকেলে অপর একটি মিছিল পুরনো শহর থেকে ফেরার সময় ঢাকেশ্বরী রোডস্থ ‘আজাদ পত্রিকা’ অফিসের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে আক্রমণের চেষ্টা করে। সেদিন পরষিদ ভবনের পার্শ্ববর্তী ফুলার রোড ও নবাবপুর রোডের ‘স্টুডিও এইচ’এর সুখে দুটি কিশোর ঘটনাস্থলেই গুলিতে নিহত হয়। শহরব্যাপী গ্রেফতার, খণ্ড খণ্ড মিছিলে হামলা, হত্যা ইত্যাদি দ্বারা সরকার বিক্ষুব্ধ জনতাকে বিভ্রান্ত, শক্তিহীন ও স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। অত্যাচারী শাসকদের রণহুঙ্কার শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের স্তম্ভিত করে দেয়। ১৯৫২ সালের এসব ঘটনা রক্তে রঞ্জিত।
এই পরিস্থিতিতে নিক্ষিপ্ত হয়ে আর্টস স্কুলের আমিনুল ইসলাম (পরে আর্টস কলেজের অধ্যক্ষ), সাহিত্যিক আবদুল্লাহ আল-মুতী (পরে তিনি এক সচিব) ও অপরিচিত সাংবাদিক আমি ‘দিলরুবা’ অফিসে একত্র হই একটা কিছু প্রতিবাদের পন্থা বের করার জন্য। বর্তমানের সেন্ট্রাল ল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এ এইচ এম আবদুল কাদের তখন দিলরুবা পত্রিকার সম্পাদক। কিছু দিন পূর্বে ময়মনসিংহ থেকে ‘চাষী’ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। বৃদ্ধ সম্পাদক মুজিবর রহমান ১৯৩৬ সালে পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ শুরু করেন। ঢাকায় আবদুল কাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কাজ সম্পন্ন করতে সাহসিকতার সঙ্গে ‘চাষী` পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা আমাদের অনুরোধে প্রকাশ করতে সম্মত হলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কারণে তিনি এই সাহসিকতাপূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। জনাব আল-মুতী ও আমার ওপর পড়লো দু’দিনের রক্তপাতের কাহিনী লেখার ভার। আর শিল্পী আমিনুল ইসলাম আঁকলেন রাজপথে গুলিবিদ্ধ মানুষের প্রতিরোধের চিত্র। যতদর মনে পড়ে, তাঁর এই চিত্রটিই হচ্ছে রক্তাক্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম স্কেচ। আমিনুলের অঙ্কিত এই চিত্রের কথা আমরা বহুদিন প্রকাশ করিনি। এই তিন সমধর্মী বন্ধুর মধ্যে এমনই একটা একাত্মা ছিল। অবশ্য নানা বোধগম্য কারণেই এই গোপনীয়তা।
এই বিশেষ সংখ্যার কাগজ, প্রেসের খরচ, ব্লকের টাকা সবই দিলরুবার কাদের সাহেব বহন করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার মধ্যেই ছাপা শেষ হয়েছিল। কিন্তু পুলিশের আক্রমণের ভয়ে সন্ধ্যার পূর্বেই আমরা এক বান্ডিল করে কাগজ নিয়ে বেরিয়ে যাই বিলি করতে। কোনো হকার ছিল না, প্রেসের কর্মচারিগণ আমাদের আগেই চলে গেছেন। তখন কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ধারণা ছিল ঢাকায় বোধ হয় আমরাই প্রথম বিশেষ সংখ্যা বের করেছিলাম। মোড়ে মোড়ে কাগজ দিয়ে আমরা যার যার বাসার দিকে এগুচ্ছি। পাটুয়াটুলিতে ‘সওগাত` পত্রিকার কাছাকাছি এসে দেখি আর একটি বিশেষ সংখ্যা পত্রিকা। বন্ধু তাসিকুল আলম খান (প্রয়াত) তখন ইকবাল হল নিবাসী এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে রেডিওর নিউজ প্রধান হয়েছিলেন। তাঁদের বিশেষ পত্রিকা বিলি করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে ‘অগত্যা সম্পাদক ছিলেন এককালে টেলিভিশনের বিশিষ্ট অনুষ্ঠান পরিচালক জনাব ফজলে লোহানী ও প্রকাশক নাসির হায়দার (সবুজ), যিনি পরবর্তীকালে বয়িং, বিমানের প্রথম শ্রেণীর পাইলট ছিলেন (বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন)’। বিশিষ্ট সাহিত্যিক-গবেষক ও বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ‘খালিজ টাইমস` পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক মাহাবুব জামান জাহেদী ও সাহিত্যিক-নাট্যকার আনিস চৌধুরী ও তাসিকুল আলম খান ছিলেন পত্রিকাটির নিয়মিত প্রধান লেখক। জাহিদী ও তাসিকুল সে সময় অবজারভারের সাব-এডিটর ছিলেন। এরা অনেকে সেদিন উল্লিখিত বিশেষ সংখ্যাটি প্রকাশের সাথে জড়িত ছিলেন। কবি ও সাহিত্যিক কয়েকজন লেখক এই সংখ্যাটি সমৃদ্ধ করেছিলেন রচনা দ্বারা।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও ফজলে লোহানী সে সময় মুসলিম লীগের সমর্থক দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদকরূপে কাজ করতেন। ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের পর দুই বন্ধু ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে আমিও ‘সংবাদ’ থেকে বিদায় নেই ইত্তেফাকে।
পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক দুই ভাই আবদুল মোহাইমেন ও আবদুল মুকীত তাঁদের প্রেসে গোপনে পত্রিকাটি ছাপতে দিয়ে যে সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার তুলনা নেই। তাদের সহযোগিতা না পেলে সেদিন অন্য কোন প্রেস থেকে এই অগত্যা গোষ্ঠীর বিশেষ সংখ্যা বের করা সম্ভব হত কী না সন্দেহ।
বিশেষ সংখ্যাটি ছাপাবার পর পুলিশের হাত থেকে রক্ষার জন্য জাহেদী গেঞ্জি গায়ে কলি বেশে রিকশায় করে মেডিক্যাল কলেজের মোড় পর্যন্ত পত্রিকা বহন করেছেন। এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক তাসিকুলই তাঁর কাছ থেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে বিতরণ করেন বিশেষ সংখ্যা পত্রিকাটি। এভাবেই রাতের অন্ধকারে কয়েকজন যুবক হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার, রক্তপাতের কাহিনী ঢাকা শহরের মহল্লায় মহল্লায় দুটি বিশেষ সংখ্যার মাধ্যমে পৌছে দিয়েছিলেন। এ সমস্ত উদ্যোগ, ঝুঁকি ও সাহসিকতা জাতীয় জীবনের এক মহান ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের অলক্ষ্যযোগ্য কর্ণিকা মাত্র। তবুও কোনো কোনো সময় স্মরণে আসা অস্বাভাবিক নয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তীব্র গতিধারা ও হত্যাকাণ্ড নির্যাতনের ইতিহাসকে সেদিন আমরা ক’জন যুবক লিপিবদ্ধ করে রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। এগুলো খণ্ডিত পার্শ্ব ঘটনা।।
লেখাটি ফয়েজ আহমদের [মধ্যরাতের অশ্বারোহী ‘অখন্ড’] বই থেকে সংকলিত করা হয়েছে।
[ফয়েজ আহমদ প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯২৮ সালের ২ মে তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বাসাইলভোগ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী এবং মা আরজুদা বানু। প্রথিতযশা এই সাংবাদিক ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। দেশ ও সমাজের অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল আমৃত্যু। লেখালেখি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।]
বাংলা ইনসাইডার/এআরএন
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭