ইনসাইড আর্টিকেল

ফাল্গুন: ভালোবাসা নাকি দ্রোহের?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/02/2019


Thumbnail

নতুন সকালে চোখ মেললেই আজ নতুন এক ঋতু, আমাদের ঋতুরাজ বসন্ত। বাইরে পা দিতেই দেখবো যেন নতুন রঙে সেজেছে প্রকৃতি আর মানুষগুলো। হলুদ আর বাসন্তী রঙে সাজগোজ, কাঁচা ফুলের গন্ধ, মৃদুমন্দ মিষ্টি বাতাস আমাদের মনটা ভালো করে দেবে নিশ্চয়ই। এই ফাল্গুন আমাদের সামনে  ভালোবাসার অনেক সৃষ্টি এনে দেয়। এই ভালোবাসার পাশাপাশি ভেতরে এক দ্রোহের ভাব নিয়ে আসে, সেটা আমরা সবসময় টের না পেলেও ভেতরে ধারণ করি। তাই ফাল্গুন যেমন ভালোবাসার, তেমনি দ্রোহের।

ভালোবাসার ফাল্গুন

পুরনো কিছুর পরে নতুনের অপেক্ষা আমাদের চিরদিনের। শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সাজবে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ ছোট কচি পাতা। ধীরগতিতে বাতাসের বয়ে চলা জানান দেয় নতুন সম্ভাবনার। সূর্যোদয়ের সঙ্গে অভিষেক ফাল্গুনের, ঋতুরাজ বসন্তের। শীতে খোলসে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া  অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠবে, আমরা সেই প্রতীক্ষা করি।

মাঘের শেষেই ফাগুন হাওয়ার দোল লেগে যায় বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয় প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। গাছে গাছে ফুটছে আমের মুকুল। বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধে বসন্ত জানিয়ে দিচ্ছে, সত্যি সত্যি সে আজ জাগ্রত দ্বারে।

বসন্ত মানে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গনে বর্ণিল সমাহার। বসন্ত মানেই ফুলের অবাধ বিচরণ। ফুলের প্রেমে পড়েই কতবছর আগে করিগুরু লিখে গেছেন ‘আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে…’ ফাগুন আসার আগেই গাছে গাছে ফুলের সমারোহ মানে বসন্তের আবাহন। ভোমর, মৌমাছির গুঞ্জন কান পাতলেই শোনা যায়। ফররুখ আহমেদের সেই লেখার মতো- ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী, ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানি

শীতকালকে অনেকে বুড়ির সঙ্গে তুলনাও করেছেন। শীতের বুড়ি চলে যাওয়ার পর বসন্তকাল বাংলার প্রকৃতিতে রমণীর রূপে আসে, রাজকীয় রূপে সাজে। শীতের ঝরেপড়া পাতার ফাঁকা জায়গা পূরণ করবে নতুন নতুন পাতা। রঙিন টকটকে সব ফুল, সেই সঙ্গে গাছে গাছে নাম জানা না জানা পাখির কিচিরমিচির আর কোকিলের কুহুতান। খুব আদর ভালোবাসায় মাখে প্রকৃতি। এই প্রকৃতিতে তো ভালোবাসতে ইচ্ছে করবেই। ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করবে। হারানো ভালোবাসাকে ফিরে পেতে মন চাইবে। মনে পড়ে কবিগুরুর সেই গান-

আমার প্রাণের `পরে চলে গেল কে

বসন্তের বাতাসটুকুর মতো

সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-

ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত

সে চলে গেল, বলে গেল না-

এই যে ভালোবাসার মানুষের চলে যাওয়া, তাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি বোধহয় এই রঙিন বসন্তেই বেশি আসে।

দ্রোহের বসন্ত

তবে বসন্ত তো কেবল ভালোবাসা আর প্রেমে মোড়ানোই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্রোহের সব স্মৃতি। আমাদের আন্দোলন, অন্যায় রুখে দাড়ানোর ইতিহাস। আমরা বাঙালিরা কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে শিখিনি। ভালোবাসা আর প্রেমের পাশাপাশি এই ফাল্গুনেও রচিত হয় দ্রোহের ইতিহাস। ভালোবাসা আর দ্রোহ একেবারে মিলেমিশে গেছে। কেউ কেউ আবার বলেনও যে, ভালোবাসা না থাকলে দ্রোহ আসেই বা কীভাবে?

আমরা অনেককিছু ভুলতে পারলেও আমাদের ভাষা আন্দোলনকে একেবারে ভুলতে পারবো না। ভাষার মতো অমূল্য ধনকে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাণ দিয়েছিল একমাত্র বাঙালিরাই। সেটাও এই ফাল্গুনে। এই আন্দোলনের হাত ধরেই আমাদের সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে ফাল্গুন হয়ে উঠতে থাকে দ্রোহের মাস, বসন্ত হতে থাকে দ্রোহের ঋতু।

পলাশ-শিমুলের আগুনে দ্রোহের সংগতে জ্বলে উঠেছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। এই বিরাট আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩, অর্থাৎ এই ফাল্গুনেই। এই আন্দোলনে প্রাণ যায় তাজা তরুণদের, আমাদের ইতিহাসে চাপা পড়া কলঙ্কময় এক অধ্যায়ের। স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও শিক্ষা রক্ষার আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিলেন অনেকেই।

সেই দ্রোহকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সাহিত্যে যোগ হয়েছে বিদ্রোহের অনেক লেখা। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় যোগ করেছেন দ্রোহের যতো পঙক্তি। এই বসন্তের দ্রোহ নিয়ে অসংখ্য লেখা আজও আমাদের সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য। মনে পড়ে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ এর কথা। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ‘একুশের গল্প’র কথা। এমন অনেক স্মৃতিকথা আর মনের বিদ্রোহ নিয়ে লেখা তো আজও আমাদের প্রাণবন্ত করে। নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলে।

তবে আমাদের সব দাবি একখানে। আমরা যেন তারা শিমুল আর পলাশের রঙ পোশাকেই আটকে না রাখি। ফাগুনের আগুন রঙ যেন আমাদের চোখেমুখে আর হৃদয়ে অম্লান থাকে। বুকে ভালোবাসা আর দ্রোহ একসঙ্গে জেগে উঠুক।

 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭