ইনসাইড আর্টিকেল

ভাষার প্রতি ভালোবাসা কি একদিনের?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 21/02/2019


Thumbnail

ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়,

ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে।

না, ভাষার মাধ্যমে জব্দ করে বাঙালিদের হাতে পায়ে শিকল পরাতে পারেনি কেউ। শহীদ দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষাকে ছিনিয়ে এনেছিল শোসকদের থাবা থেকে, সেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। দেশকে কতোটা ভালো না বাসলে এমনটা সম্ভব হয়, আমাদের সেটা কল্পনায় আসে না। তাই হয়তো উদযাপনের খাতিরে আমরা দিনটিকে বিশাল উদ্দীপনাতে পালন করি। কিন্তু বাকি দিনগুলোতে ভাষার অর্জনের ইতিহাসকে কেন ভুলে যাই? উত্তর জানা নেই। 

বাঙালি জাতি কি আসলেই মন থেকে মনে রেখেছি একুশকে? মনে হয় না। বসন্তের নবম দিনটাই বরাদ্দ করা ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে। বাকি দিনগুলোতে তো আমরা সব ভুলেই বসে থাকি, স্মরণ করা তো দূরে থাক। একদিনের জন্য তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে যদি বাকি দিনগুলোতে তাদের অসম্মান করি, এই ভালোবাসার প্রয়োজন কি?

আজকের দিনটাতেই কেবল প্রিয় শহীদ মিনারটাতে মুখরিত মানুষের ঢল নামে। অথচ অন্য সময়ে একেবারেই অন্যচিত্র। এই স্মৃতিবিজড়িত জায়গাতেই বিভিন্ন লোকজন যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে বসে থাকে, বাদাম খায়, আড্ডা দেয়। যেন এটা বেড়াতে আসার পার্ক। এমনকি তাদের পায়ে থাকে জুতো। আর একুশের দিনটিতে সারাবছরের শ্রদ্ধা জমিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে সবাই, গায়ে সাদা আর কালোর ছোঁয়া। একটা শোকের আবহ। প্রভাতফেরির শান্ত শোভাযাত্রা। সবার হাতে রঙিন সব ফুল!

এই উদযাপন দেখে বোঝা যায় আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই বুঝি এতো এতো আয়োজন।

আমরা মন থেকে কিন্তু একুশকে ভুলিনি, এখনো ভালোবাসি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি…’ এই গানটা শুনলে এখনো চোখের কোণে অশ্রু জমে, মন শিহরিত হয়। আমরা শুধু একুশকে আটকে রাখতে পারিনি, সবকিছুর মধ্যে একুশ আর ভাষাকে তুলে আনতে পারিনি। শহীদ মিনারের সামনে বছরের যেকোনো দিনেই গেলে এমনিতেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।

যারা ভাষার জন্যে এভাবে প্রাণ দিয়ে মহামূল্যবান ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করলো, তাদের জন্য শুধু এই দিনটাতেই কেন শুধু এতো লোকদেখানো শ্রদ্ধা জানাতে হবে? প্রতিদিন নয় কেন?

সারাদিন, সারাবছর কানে বাজে হিন্দি বা ইংরেজি গান। আর শুধু এইদিনে বাজে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। অন্যের ভাষার গান শোনাটাকে অপরাধ বলছি না, তবে সেটা নিজের ভাষাকে উপেক্ষা করে তো নয়। এফএম স্টুডিওগুলো খুললেই আজকাল ভিমরি খেতে হয়। কি সব বাংলা ইংরেজিতে মেলানো মেশানো হিজিবিজি ভাষা সেখানে শুনতে হয়, বিরক্তি ধরে যায়। আবার বহুল পছন্দনীয় টকশোগুলোতেও ঐ একই অবস্থা। হয় ইংরেজি নয় বাংলাকে বেছে নিন। ভাষা নিয়ে এমন বিশৃঙ্খলা কেন? নিজের ভাষায় কথা বললে কি স্মার্টনেস চলে যায় নাকি শিক্ষিতের খাতা থেকে নাম কাটা যায় কে জানে।

সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমগুলোতে তো আরও খারাপ অবস্থা। সেখানে কোনো ভাষা মেনে চলা হচ্ছে না। সেখানে বাংলা অক্ষরে লেখা হয় ইংরেজি কথা, ইংরেজি অক্ষরে লেখা হয় বাংলা কথা। এর থেকে হাস্যকর বিষয় আর হয় না। কষ্টও লাগে। এতো কষ্ট করে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে কি লাভ হলো। অথচ একুশের দিনটিতে একুশের সাজে শাড়ি পড়ে, একুশের গান কবিতার দু একটি লাইন লিখে সবাই সামাজিক মাধ্যমে দেখাতে চায় ভাষাকে কতোই ভালোবাসা।

একুশ তারিখটা এখন যেন শুধু নিয়ম পালনের মধ্যেই বন্দী। ফ্যাশন হাউজগুলোতে সাদা আর কালো পোশাকের রমরমা অবস্থা দেখা যায়। শহীদ মিনারগুলোতে নতুন রঙের ছোঁয়া, আলপনা দেখা যায়।  রাস্তার মোড়ে কালো ব্যানার, পতাকা। স্কুল কলেজগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ফুলের দোকানগুলোতে তোরণ আর মালা তৈরির ভীড়। এই দিয়েই আমাদের একুশের দিনটা সাজানো। আর বাকি ৩৬৪ দিনটা মানেই হলো নৈব নৈব চ।

নাম জানা না জানা ভাষা শহীদরা তো এই দশা দেখার জন্য তাজা রক্ত ঢেলে দেয়নি। আমাদের তো ঠিক তাদের মতো করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’শ্লোগান দিতে পারবো না, ‘বাংলা আমার মায়ের ভাষা’বলে তপ্ত রাস্তায় আমাদের আর নামতে হবে না। আমাদের প্রধান কাজ ভাষা আর সংস্কৃতিটাকে শ্রদ্ধা করা। ভাষাকে কোনোভাবেই দূষিত না করা। একুশের বন্দনা সারাবছরেই কেন মনের মধ্যে রেখে দেইনা? ভাষাকে ভালোবাসি, ভাষার শুদ্ধ চর্চা করি, দেশকে ভালোবাসি। আমাদের মায়ের ভাষাকে আর যেন হেলাফেলায় অসম্মান না করি, প্রতিদিন সমান ভালোবাসি। এটাই হোক একুশের প্রত্যাশা।

 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭