ইনসাইড আর্টিকেল

শেখ মুজিব আমার পিতা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 17/03/2019


Thumbnail

আজ ১৭ মার্চ, সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর শৈশবকালের নানা ঘটনা। জাতির পিতার জন্মদিনে আমরা ঘুরে আসবো শেখ হাসিনার লেখা ‘শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-১’ এর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ অধ্যায়ে জাতির পিতাকে নিয়ে লেখা ঘটনাবহুল শৈশব-কৈশোর থেকে। 

বইয়ের ১১৩ থেকে ১১৮ পাতায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের পূর্ব-পুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালান বাড়ি তৈরি করেন, যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালে যে দুটো দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটোও জ্বালিয়ে দেয়। এই দালান-কোঠায় বসবাস শুরু হওয়ার পর ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমানও এ বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। আর এখানেই জন্ম নেন আমার আব্বা, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আমার আব্বার নানা শেখ আবদুল মজিদ আব্বার আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমার দাদীর দুই কন্যাসন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান আমার আব্বা, তাই আমার দাদীর বাবা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দাদীকে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান, মা সায়রা- তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে।’

শেখ মুজিব ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দূরন্তপনা। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলোবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি কেমন করে বাসা গড়ে তোলে, মাছরাঙা কিভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা। দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তার ভালো লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিষ দেয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তিনি যা বলতেন তারা তাই করত। আবার এগুলো দেখাশোনার ভার দিতেন ছোট বোন হেলেনের ওপর। এই পোষা পাখি, জীবজন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। মাঝে মাঝে এ জন্য ছোট বোনকে বকাও খেতে হতো। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে মধুমতী ও বাইগার নদীর সংযোগ লক্ষ্য করে। এই খালের পাড়েই ছিল কাচারিঘর। আর এই কাচারিঘরের পাশে মাস্টার, পণ্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাদের কাছে আমার আব্বা আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অংক শিখতেন।

আমাদের পূর্ব-পুরুষদেরই গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া স্কুল। তখন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূরে। আমার আব্বা এই স্কুলেই প্রথম পড়াশোনা করেন। একবার বর্ষাকালে নৌকা করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকাডুবি হয়ে যায়। আমার আব্বা খালের পানিতে পড়ে যান। এরপর আমার দাদী তাকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। তার একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল, তার এতটুকু কষ্ট যেন সকলেরই কষ্ট। সেই স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। গোপালগঞ্জ আমার দাদার কর্মস্থল ছিল। সেই থেকে গোপালগঞ্জেই তিনি পড়াশোনা করতে শুরু করেন। মাঝখানে একবার দাদা মাদারীপুর বদলি হন। তখন কিছুদিনের জন্য মাদারীপুরেও আব্বা পড়াশোনা করেন। পরে গোপালগঞ্জেই তার কৈশোর বেলা কাটে।

আমার আব্বার শরীর ছিল বেশ রোগা। তাই আমার দাদী সবসময়ই ব্যস্ত থাকতেন কিভাবে তার খোকার শরীর ভালো করা যায়। আদর করে দাদা-দাদীও খোকা বলেই ডাকতেন। আর ভাইবোন, গ্রামবাসীর কাছে ছিলেন মিয়াভাই বলে পরিচিত। গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে তিনি মিশতেন। আমার দাদী সবসময় ব্যস্ত থাকতেন খোকার শরীর সুস্থ করে তুলতে। তাই দুধ, ছানা আর মাখন ঘরেই তৈরি হতো। বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ সবসময় খোকার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু আমার আব্বা ছোট্টবেলা থেকেই ছিপছিপে পাতলা ছিলেন, তাই দাদীর আফসোসেরও সীমা ছিল না যে, কেন তার খোকা একটু হৃষ্টপুষ্ট নাদুসনুদুস হয় না। খাবার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাবার শেষে দুধ-ভাত কলা ও গুড় খুব পছন্দ করতেন। আমার চার ফুফু ও এক চাচা ছিলেন। এই চার বোনের মধ্যেই দুই বোন বড় ছিলেন। ছোট ভাইটির যাতে কোনো কষ্ট না হয় এ জন্য সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকতেন বড় দুই বোন। বাকিরা ছোট্ট কিন্তু দাদা-দাদীর কাছে খোকার আদর ছিল সীমাহীন। আমাদের বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। আমার দাদার বা দাদীর বোনদের ছেলেমেয়ে বিশেষ করে যারা পিতৃহারা-মাতৃহারা তাদের দাদা-দাদী নিজেদের কাছে এনেই মানুষ করতেন। আর তাই প্রায় ১৭-১৮ জন ছেলেমেয়ে একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠে।’

অতীতের ঐতিহ্য রক্ষা করে বঙ্গবন্ধুরও বিয়ে হয় অল্প বয়সে। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘আব্বার যখন ১০ বছর বয়স তখন তার বিয়ে হয়। আমার মায়ের বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর। আমার মা পিতৃহারা হওয়ার পর তার দাদা এই বিয়ে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি মা ও খালার নামে লিখে দেন। আমার খালা মায়ের থেকে ৩-৪ বছরের বড়। আত্মীয়ের মধ্যেই দুই বোনকে বিয়ে দেন এবং আমার দাদাকে (গার্ডিয়ান) মুরব্বি করে দেন। আমার মার যখন ৬-৭ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান এবং তখন আমার দাদী কোলে তুলে নেন আমার মাকে। আর সেই থেকে একই সঙ্গে সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মানুষ হন।

আমার আব্বার পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন, তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে, বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়ত।

আব্বা যদি ধারে-কাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হলো- মাঝে মাঝে আব্বার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হতো। এখনও আমি যখন ওই সব এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়, যারা আব্বার ছোটবেলার কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে এই খেলার অনেক ফটো ও কাগজ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফলে সব শেষ হয়ে যায়।’

দানশীলতার জন্য বঙ্গবন্ধু বরাবরই স্বনামধন্য। বঙ্গবন্ধুকন্যা লিখেছেন, ‘তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়াশোনা করত। ৪-৫ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হবে। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসত আর সারাদিন অভুক্ত অবস্তায় অনেকদূর হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংকপাড়ায়, আব্বা তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাওয়ার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদীর কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হতো, কারণ আর কিছুই নয়, কোনো ছেলে গরিব ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ, রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাদের ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।

দাদীর কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদী আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে, রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ে চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’

বঙ্গবন্ধুর শৈশবকালে দুঃসময় বয়ে আনে বেরিবেরি রোগ। বঙ্গবন্ধুর চোখ হারিয়ে যায়। ৪ বছরের জন্য তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘স্কুলে পড়তে পড়তে আব্বার বেরিবেরি রোগ হয় এবং চোখ খারাপ হয়ে যায়। ফলে ৪ বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে। তিনি সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় আব্বার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, তার নাম ছিল হামিদ মাস্টার। তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় এবং বহু বছর জেল খাটেন। পরবর্তী পর্যায়ে আব্বা বিভিন্ন সময় যখন জেলে থাকতেন অথবা পুলিশ গ্রেফতার করতে আসত, আমার দাদী মাঝে মাঝেই সেই মাস্টার সাহেবের নাম নিতেন আর কাঁদতেন। এমনিতে আমার দাদা-দাদী অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন। ছেলের কোনো কাজে কখনও তারা বাধা দিতেন না এবং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার আব্বার মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ যখনই যেটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে আমার দাদা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন।’

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দানের গুণ বিকশিত হয়েছে শৈশবকালেই। শেখ হাসিনা তার বইয়ে লিখেলছেন, ‘আব্বার একজন স্কুল মাস্টার ছোট্ট একটা সংগঠন গড়ে তোলেন এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান, টাকা ও চাল জোগাড় করে গরিব, মেধাবী ছেলেদের সাহায্য করতেন। অন্যতম সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি তার সঙ্গে কাজ করতেন এবং অন্যদের উৎসাহ দিতেন। যেখানেই কোনো অন্যায় দেখতেন সেখানেই তিনি প্রতিবাদ করতেন। একবার একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম সরকার সমর্থকদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হন ও গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকেন।

কৈশোরেই তিনি খুব বেশি অধিকার সচেতন ছিলেন। একবার যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা গোপালগঞ্জ সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। এ সময় সাহসী কিশোর মুজিব তাঁর কাছে স্কুলঘরে বর্ষার পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করবার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

গোপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। তখন বেকার হোস্টেলে থাকতেন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয়ভাবে। এ সময় থেকে তাঁর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়।’ —(সংকলিত)

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭