ইনসাইড বাংলাদেশ

পোড়া মবিল থেকে গ্যাস ও তেল তৈরি মোটরমেকানিক মিজানের

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 01/04/2019


Thumbnail

মেধা আর ইচ্ছাকে একসঙ্গে করে অনেক দুঃসাধ্যকেই সম্ভব করা যায়। পুনঃব্যবহারের চিন্তা থেকে পুনঃউৎপাদন মেধা আর ইচ্ছার মিশেলে হয়। তারই বাস্তব প্রমাণ করলেন শার্শা উপজেলার মিজান। তিনি উদ্ভাবন করে দেখালেন পোড়া মবিল থেকে গ্যাস ও জ্বালানী তেল উৎপাদন করা যায়।

মোটরসাইকেল বা কলকারখানায় অপ্রয়োজনীয় পোড়া মবিল পরিবেশ দুষণ করে। পরিবেশ দুষণমুক্ত করতেই মিজানের এই উদ্যোগ। ইতিমধ্যে সফলও হয়েছেন তিনি। একবছর ধরে মবিল নিয়ে গবেষণা করেছেন বলে জানান মিজান।

মিজান বলেন, ‘আমি ভেবে দেখলাম আমাদের দেশে লাখ লাখ কলকারখানা, যানবাহন এবং মোটরসাইকেল গ্যারেজ রয়েছে। এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ বাতিল বা বাদপড়া মবিল। যে মবিল নষ্ট করছে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্যহানী হচ্ছে মানবদেহের। এমন চিন্তা ভাবনায় আমি গবেষণা করি এসব মবিল কীভাবে কাজে লাগানো যায়। একদিন কিছু বাদপড়া পোড়া মবিল আমি খোলা মাঠে ঘাসের উপর ফেলে আসি। কিছুদিন পর দেখি ঘাসগুলো মারা গেছে। এমনিভাবে পানিতে ফেললেও মারা যাচ্ছে মাছ। পোড়া মবিল কাজে লাগাতে যেয়ে দেখি তা থেকে উৎপাদন হচ্ছে গ্যাস ও জ্বালানী তেল। একটি কন্টিনারে পোড়া মবিল জালিয়ে গ্যাস তৈরি করেছি। রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে এই গ্যাস ব্যবহার করা যায়। আর অবশিষ্ট অংশ রিসাইক্লিং করে ডিজেল মবিল ও কেরোসিন তেল তৈরি করা যায়। এখন শুধু দরকার সরকারের সহায়তা।’

শার্শা উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের আমতলা গাতিপাড়ায় জন্ম মিজানুর রহমান মিজানের। বাস করছেন শার্শা উপজেলা সদরের শ্যামলাগাছি গ্রামে। পিতা আক্কাজ আলী এবং মাতা খোদেজা খাতুন, দুজনেই মৃত। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া শেখা হয়নি, ৮/৯ বছরে বেঁচে থাকার তাগিদ শুরু। ক্ষেতে শ্যালোমেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করেন তিনি। পরবর্তীতে নাভারন বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ করেন মিজান। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক পেশা হিসেবে কর্মজীবন শুরু।

ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা নতুন কিছু করা বা জানা। তবে মেকানিক হিসেবে ইঞ্জিন তৈরিতে প্রবল আগ্রহের বশেই অনেক চেষ্টায় মিজান তৈরি করেন ইঞ্জিন। প্রথমে উদ্ভাবন করেন হাফ ক্র্যানসেপ্ট দিয়ে একটি আলগা ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের সব যন্ত্রপাতি দেখা যেত বাইরে থেকেই। এ ইঞ্জিনটি একবার জ্বালানী তেল দিয়ে চালু করলে পরে আর তেল লাগতো না। ধোয়া থেকে জ্বালানী তৈরি করে নিজেই চলতো। এরপর পোড়া মবিল থেকে গ্যাস ও তেল তৈরি করলেন তিনি।

সফলতা আরও আছে। ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানীর পর মিজান উদ্ভাবন করেন স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র। বাসা, কলকারখানা, অফিস-আদালতে আগুন লাগলে যন্ত্রটি আগুন নিভাতে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নিভাতে শুরু করে। এ যন্ত্রটি স্বল্প জায়গায় রাখা যায়, যখনই কোথাও আগুন লাগে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণয়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম ও রেডলাইট চালু করে। পাশাপাশি সংযুক্ত মোবাইল থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফোন দেয়, যন্ত্রটি পানির পাম্পের সুইচ অন করে দেয়। যা আগুনের অবস্থান নিশ্চিতের ৫-৭ সেকেন্ডের মধ্যেই সম্ভব হয়। তারপর পানির পাম্পের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপের মাধ্যমে আগুনের অবস্থানে পৌঁছে এবং অসংখ্যা ছিদ্রযুক্ত ফাপা বলের আগুনে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগুনটি নিভে যায়। এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৫ সালে যশোর জেলা স্কুলের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় মিজান এটি প্রদর্শন করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে এটি বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় ১ম ও ২য় স্থান অধিকার করে।

দেশে পেট্রোল বোমায় যখন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল, সেই সময় মিজান উদ্ভাবন করেন তার তৃতীয় উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধ জ্যাকেট। এ জ্যাকেট গাঁয়ে দিয়ে ড্রাইভার বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। আগুনের মাঝে গিয়ে জানমাল রক্ষা করার সময় তার শরীরে আগুন স্পর্শ করবে না। চতুর্থ উদ্ভাবন ছিল অগ্নিনিরোধ হেলমেট। এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনায় আগুনে গলার শ্বাসনালী পুড়বে না। তার ৫ম উদ্ভাবনায় ছিল প্রতিবন্ধিদের জীবন মান উন্নয়নে মোটরকার উদ্ভাবন। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রোলচালিত।

কৃষকদের স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র উদ্ভাবন ছিল তার আরেকটি উদ্ভাবন। কৃষকরা দূর-দূরান্তের মাঠে জমিতে পানি দিতে আর ক্ষেতে যেতে হবে না। বাড়ি বসেই সেচ যন্ত্রটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। তাছাড়া এ যন্ত্রটি জমিতে পানির প্রয়োজন হলে নিজেই চালু হয়, পানির প্রয়োজন না থাকলে এটি নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। দেশীয় প্রযুক্তিতে মিজান তার পরবর্তী উদ্ভাবন করেন পারিবারিক মোটরযান। ব্যবহারযোগ্য এ যানটি এলাকার সবার মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। মিজানের এরপরের উদ্ভাবন পরিবেশ সেফটি যন্ত্র। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখী কাজ করে থাকে। বাসা, অফিস বা কলকারখানায় এটা ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার হয়। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি কাজ করে। এ যন্ত্র উদ্ভাবনের পর ২০১৬ সালের ৫ জুন মিজান পরিবেশ পদক লাভ করেন। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মিজান এ পর্যন্ত ৩৮টি সাফল্য সনদ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্যা ক্রেস্ট ও সাফল্য পুরষ্কার।

ইতিমধ্যে মিজানের উদ্ভাবনার দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ টু আই প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে ছোট অ্যাম্বুলেন্স তৈরির পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে পরিবেশবান্ধব যন্ত্র আবিষ্কারে বিশ্ব পরিবেশ পদক নির্ধারিত হওয়ায় ৫ জুন ২০১৭ তে মিজানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

মিজান জানান, তার স্বপ্ন দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা এবং আরও নতুন নতুন উদ্ভাবন সৃষ্টি করা। এরই ধারাবাহিতকায় ২০১৯ সালে তিনি তৈরি করলেন বাতিল পোড়া মবিল থেকে গ্যাস ও জ্বালানী তেল।

 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭