ইনসাইড থট

টেকসই নগরায়নে জাদুঘর!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 02/04/2019


Thumbnail

একটি পরিকল্পিত কিংবা টেকসই শহরের জন্য অনেক ব্যবস্থাপনার কথাই আমরা বলে থাকি বিভিন্ন সময়ে। সবুজ মাঠ, পায়ে হাঁটার রাস্তা, দোকানপাট, সাইকেল লেন ইত্যাদি - কখনো কি ভেবে দেখেছি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাদুঘরগুলো কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে? বিষয়টি নিয়ে আদৌ আমরা কি খুব বেশি দূর ভেবেছি? নাকি জাদুঘর নামক কিছু অবকাঠামো তৈরি করে বছর ধরে সেখানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দায়িত্ব শেষ করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি? কথাগুলো বলছি এই কারণে শহরকেন্দ্রিক জীবন যাপনে ছুটির দিনগুলোতে কর্মব্যস্ত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমরা কখনো ছুটছি খোলা সবুজ মাঠে, কখনো বা স্থানীয় পার্কে কিংবা আশপাশের কোন জাদুঘরে, ইংরেজিতে যাকে বলে মিউজিয়াম। শহরে কোন স্থানে যখন কোন উন্নয়ন হয় তখন কি আমরা ভাবছি সেখানে একটি জাদুঘর নগর জীবনে কি প্রভাব ফেলতে পারে আমাদের ঘুনে ধরা সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে?

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষ্যমতে অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ২৫০০ মিউজিয়ামে প্রতিদিন একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ঘুরতে আসে দিনের বিভিন্ন সময়ে, যেখানে ৬৫ থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধের সংখ্যা সব থেকে বেশি থাকে। যখন কোন মিউজিয়ামে ঘুরতে আসে সাধারণত তারা একা আসে, কখনো কখনো কয়েকজন মিলে আসে কিংবা নাতি নাতনীদের সাথে নিয়ে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে এই মিউজিয়ামে ঘুরতে ঘুরতে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বাড়তে থাকে, যা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, কালচারাল সম্পর্ক আরও ত্বরান্বিত করে এবং বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্বতা কিংবা সামাজিক সম্পর্কের মানদণ্ডে দেখা গেছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিঃসঙ্গতা, উচ্চ রক্তচাপ, অবসাদ এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। কিন্তু এই বয়স্ক ব্যক্তিদের যদি সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা যায় তাহলে এগুলো থেকে তারা কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে সামাজিক সুস্বাস্থ্য এবং শিল্পের মধ্যে একটি বড় যোগসূত্র রয়েছে যার অভাব মিউজিয়ামগুলো অনেকটাই পূরণ করতে পারে। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব। তাছাড়া মিউজিয়ামগুলোতে ইনফরমাল লার্নিং অনেক বেশি হয় যা সাধারণত সারা বছর স্কুল-কলেজের বইয়ের পাতা থেকেও হয় না। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে মিউজিয়াম গুলো শহরের জন্য সামাজিক স্থান হিসেবে পরিলক্ষিত হয় এবং মনের মধ্যে নতুন কিছু স্বপ্ন কিংবা আশা জাগায় সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। নিজেকে বুঝতে শেখায়, এক কথায় সামাজিক মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলে প্রজন্মের মধ্যে।

উইকিপিডিয়া থেকে দেখা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বমোট জাদুঘর রয়েছে ১০৩টি—যেখানে সব থেকে বেশি জাদুঘর রয়েছে ঢাকাতে প্রায় ১৬টির মত। এছাড়া চট্টগ্রামে ৩টি, খুলনাতে একটি, বরিশাল ও রাজশাহীতে ৫টি করে,  সিলেটে দুইটি, রংপুরে ৩টি - যা বিভাগীয় শহরগুলোর জনসংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত কম বলে প্রতীয়মান। অনেক দেশে দেখা যায় বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন রকম মিউজিয়াম থাকে, যেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মিউজিয়ামগুলো খুলে রাখা হয়। কারণ তাদের ভাষ্যমতে এই এক একটি মিউজিয়াম যেন এক একটি পাঠাগার। কিন্তু আমাদের দেশে দেখতে পাওয়া যায় মিউজিয়ামগুলো বিভিন্ন রকম সমস্যায় জর্জরিত। এমনকি এর সংস্কার কিংবা নতুন কোন সংযোজন হয় অত্যন্ত ধীরগতিতে বছরের পর বছর ধরে। এমন কি জনবল স্বল্পতার কারণে সাধারণ কার্যক্রম ব্যাহত হয় অনেক ক্ষেত্রে। তাছাড়া মিউজিয়ামগুলোর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে কারণ এক একটি মিউজিয়াম এক একটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে তাদের স্থাপত্য বহিঃপ্রকাশ ভিন্নতর হবে এটিই স্বাভাবিক। মিউজিয়াম গুলোতে প্রয়োজনীয় বসার স্থান, আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাপনা ঠিক আছে কিনা নির্দিষ্ট সময় পরপর তা পরীক্ষা করা উচিত। কারণ সরেজমিনে দেখা গেছে অনেক মিউজিয়ামে প্রয়োজনীয় আলো বাতাস চলাচলের অভাবে মূল্যবান দ্রব্যাদি প্রায় বিনষ্টের কাছাকাছি। তাছাড়া মিউজিয়াম গুলোর আধুনিক প্রচার প্রচারণা কমিউনিটির মানুষদের মধ্যে আরো উৎসাহিত করতে পারে ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার ব্যাপারেৎ।

তাছাড়া আমাদের দেশে গ্রাম বা মফস্বলের মানুষের কথা দূরে থাক, শহরকেন্দ্রিক মানুষগুলো অনেকেই জানেন না মিউজিয়ামগুলোর কার্যকারিতা এবং শহরের কোথায় কোথায় এর অবস্থান। শহুরে জীবনে মিউজিয়ামগুলোর প্রভাব খুব বেশি নয়, একটি টেকসই এবং উন্নত দেশ গঠনে যা অত্যন্ত প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে জাদুঘরের প্রধান কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড এবং কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন নাগরিক এবং সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, ইতিহাসের মূলকে ধরে রাখা। তাই জাদুঘরগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহের কথা ভাবতে হবে একটি টেকসই শহরের উন্নয়নের লক্ষ্যে। এমনকি দেশে শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা শিল্পকলার জাদুঘর উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের ভাবতে হবে জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক জাদুঘর, বিভিন্ন ধরনের লোক শিল্প জাদুঘর, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি জাদুঘর, যানবাহন, কৃষি, শিল্প থেকে শুরু করে এমনকি ছোটদের জন্য জাদুঘরের কথা। শুধুমাত্র শহরের পর্যায়ে নয়, মফস্বল কিংবা গ্রামের ক্ষেত্রেও ভাবতে হবে। একটু অন্যভাবে যদি চিন্তা করা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে যদি সেই গ্রামের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে একটি মিউজিয়াম তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে একদিকে যেমন গ্রাম পর্যায়ে কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, অন্যদিকে গ্রামগুলো নিজস্ব স্বকীয়তায় বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম। আর এটি হতে পারে গ্রাম উন্নয়নে চিন্তার বহিঃপ্রকাশ যেখানে মিউজিয়ামগুলো একটি সমাজের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করতে পারে। জাদুঘর নির্মাণ ছাড়া দেশীয় শিক্ষায় পূর্ণাঙ্গ শিল্পের বিকাশ এর কোন বিকল্প নেই।

 

বাংলা ইনসাইডার/এমআর



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭