নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 10/04/2019
বরাবরই ভদ্র ছেলে ইসতি। তবে একটু ছটফটে, দুরন্ত, বাবা-মায়ের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধুর মতো। কথা ছিল অষ্টম শ্রেণীতে উঠলে জন্মদিনে ফোন কিনে দিতে হবে। যেই কথা সেই কাজ, বাবা ১৩তম জন্মদিনে কিনে দিলো স্মার্টফোন। ইসতিকে আর কে পায়! এই ফোন কেনার পরেই বাড়তে থাকলো বন্ধু সংখ্যা, গল্প, আড্ডা। এলাকার কোচিংএ বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলে পড়তে যেতে একটু যেন বেশিই ভালো লাগতো তার। কারণ তেমন কিছু না, সেখানে পড়তে আসা বন্ধু নওমিকে আলাদা করে ভালো লাগা। সেই সঙ্গে সারাক্ষণ তার সঙ্গে ফোনে মেসেজ, কথা বলতে বলতে কখন যে প্রেমের সম্পর্ক হলো, টেরও পায়নি।
এর মধ্যে কত চড়াই উতরাই এলো। সেই আগের ইসতি এখন নেই। বাবা-মাকে লুকিয়ে দেখা করতে হচ্ছে নওমির সঙ্গে, দরজা বন্ধ করে ঝগড়া করতে হচ্ছে, টাকা ম্যানেজ করে গিফট দিতে হচ্ছে- বাবা-মা সেগুলো বুঝেও বুঝে উঠছে না যে ছেলেটা এমন বদলে গেলো কেন। খিটমিট করছে কেন, লুকিয়ে থাকছে কেন, দেরি করে বাড়িতে কেন ফিরছে, পড়াশুনায় খারাপ কেন করছে- এমন হাজারো প্রশ্ন তাদের মনে।
বিজ্ঞান এবং গবেষণা বলে, হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর প্রভাবে দুজন টিনএজার বা কিশোর-কিশোরীর মধ্যে জন্ম নেয় পরস্পরের প্রতি তীব্র টান। সাধারণভাবে বললে এই টান যেসব সময় প্রেমে পরিণত হয় তা নয়, অনেক সময় দেখা যায় উচ্ছ্বাসের কারণে অন্তরঙ্গতা বাড়ছে কিন্তু পরস্পরের মধ্যে কোনো দায়বদ্ধতা নেই; ফলে তা সত্যিকারের প্রেমে পরিণত হতে পারে না।
কম বয়সে আবেগগুলো থাকে এলোমেলো। হঠাৎ করেই একজনকে ভালো লাগতে থাকে। মনে হয় তাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন। সব যুক্তি, বাস্তবতা আবেগের কাছে হেরে যায়। প্রেমময় আবেগ যেমন উথলে ওঠে, তেমনি ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি আবেগগুলোর প্রকাশভঙ্গি হয় অনিয়ন্ত্রিত।
কেন, কীভাবে হয় এমন প্রেম
টিনএজারদের মধ্যে আবেগের সম্পর্ক মোটেই অস্বাভাবিক নয়। শারীরিক আর মানসিক পরিবর্তনের কারণে পরস্পরের প্রতি আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই আবেগের বয়সে স্কুল বা কলেজগুলোতে সমবয়সী বা একটু ছোট-বড় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মেলামেশার খাতিরে ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়।
আমাদের সংস্কৃতিই পাল্টে গেছে। এখন ছেলেমেয়েরা খুব খোলামেলাভাবে মেলামেশা করে। আগেরদিনের মতো পরিবার থেকে মেলামেশায় তেমন বাধা দেওয়া হয়না, তাদের সঙ্গে বাসায় আসা যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া এসব এখন অনেকটাই খোলামেলা। তাই প্রেমে বাধা পড়ছে না।
সিনেমা নাটকগুলোও তো বাস্তব থেকে হয়। সেখানে টিএজারদের তুমুল প্রেম দেখানো হচ্ছে। আমাদের প্রজন্মগুলো সেখান থেকে শিখছে জানছে। বেপরোয়া বা আবেগপ্রবণ হয়ে সেগুলো মনে ধারণ করার চেষ্টা করছে। সেখান থেকেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আসক্তি, প্রেমের গভীরতা বাড়ছে।
মুঠোফোনে অপরিচিত কারও সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করা, সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত বা অপরিচিতদের সঙ্গে আবেগী সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া থেকে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আবার পারিবারিক কারণে একাকিত্ব বা হতাশায় ডুবে থাকা কিংবা অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়া থেকেও এটা ঘটতে পারে। গবেষণা মতে, এমন আবেগী প্রেমে জড়ানোর অন্যতম কারণ পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা না পাওয়া। এমন ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। চোখের নেশায় ভুলে যায় সবকিছু। এসময়ে মানসিক রোগাক্রান্তও হয়ে পড়তে পারে কেউ।
পরিণতি কি হতে পারে
টিনএজদের প্রেমের পরিণতি অনেকক্ষেত্রেই নেতিবাচক হয়। এই যেমন বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া। কিশোর-কিশোরীরা অনেকটা না বুঝেই প্রেম করে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলতে পারে। এতে অল্পদিনেই বিয়ে-বিচ্ছেদ, ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি। অবুঝ বয়সে বিয়ের পর মানিয়ে নিতে পারে না অনেকেই। এসময় তারা না পারে পরিস্থিতি সামাল দিতে, না পারে নিজ পরিবারের কাছে ফিরে যেতে। গভীর হতাশা নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এ যাত্রায় ঘটতে পারে বিয়ে-বিচ্ছেদ। অল্পবয়সে বিয়ে-বিচ্ছেদের পরিণতিও হয় মারাত্মক।
এদিকে, আইনগতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ হওয়ায় এমন বিয়ের ঘটনা ঘটলে আইনের মুখোমুখি হতে হবে ছেলে-মেয়ে এবং বিয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের।
বিয়ে তো পরের কথা। কখনোবা বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কের জেরে অল্প বয়সেই হচ্ছে গর্ভধারণের ঘটনা। অসম্ভব বুঝে সেটা গর্ভপাতের মতো অপরাধের দিকে চলে যাচ্ছে। অপরিণত প্রেম, সম্পর্কের কারণে নিজেদের মধ্যে কলহ বাড়ছে। আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্তও নিচ্ছে এই বাল্যপ্রেমের জুটিরা।
আবার এই বয়সের প্রেমে সিরিয়াসনেসের ঘাটতি থাকে বলে প্রেমের পরিণতি শেষ পর্যন্ত টেকে না। প্রেম ভেঙে যায়, মনোমালিন্য হয়, তিক্ততা থেকে একে অপরের প্রতি বিধ্বংসী মনোভাব তৈরি হয়। কোনোকারণে সম্পর্কটি ভেঙে যায়, তখন ক্রোধ আর হিংসা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এ সময় আবেগকে সামলে রাখা খুবই জরুরি। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ভয়াবহতম সিদ্ধান্ত নিতে পারে টিনএজ মন।
মা-বাবা কি করবেন
মা-বাবার চোখের সামনে থেকেও যেন আড়ালে হারিয়ে চলে যায় কিশোর-কিশোরী। অভিভাবক শ্রেণী কমবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সম্পর্ককে বড় অপরাধ ভাবেন। উত্তেজিত হয়ে বাধা দিতে চান। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা না করে, তাদের বুঝিয়ে না বলে, সম্পর্কটা আসলেই প্রেম কি না, তা না বুঝে উত্তেজিত হলে টিনএজাররা কিন্তু মানসিকভাবে চরম আঘাত পাবে। অভিভাবক আর শিক্ষকদের এই বিষয়টিতে সতর্কতার সঙ্গে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষা, ভালোবাসা আর পরিমিত নিয়ন্ত্রণ এসময়ে খুবই প্রয়োজন। এতে করে অল্প বয়সে প্রেম এবং বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয় থেকে দূরে রাখা সম্ভব ছেলেমেয়েদের। উঠতি বয়সে তার মনোজগতে কী ঘটছে, সে বিষয়ে একটু বাড়তি খেয়াল রাখুন। রাগ না করে বুঝিয়ে বলুন সবকিছু। অভিভাবক হয়েও ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো খোলামেলা কথাবার্তা বলুন।
বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭