ইনসাইড আর্টিকেল

পয়লা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/04/2019


Thumbnail

এলাকার সবচেয়ে বড় মাছের বাজারে দেখা হলো দুই প্রতিবেশীর। প্রচণ্ড ভিড় সেখানে, একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলো কি মাছ কেনা হচ্ছে। তিনি জানালেন ইলিশ মাছ। বৈশাখে ইলিশ মাছ না হলে চলবে না বলেই তার পরিবারের সবাই মনে করে। অগত্যা এতগুলো দাম দিয়ে কিনতেই হচ্ছে ইলিশ। আশেপাশে অনেকেই কিনছে। আরেকজন অবশ্য ইলিশ মাছ নিয়ে তেমন চিন্তিত নন। তিনি একটা প্রশ্নই করলেন, ‘আচ্ছা পয়লা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের আসলেই কি কোনো সম্পর্ক আছে?’

এই প্রশ্ন আমাদেরও। ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ এবং এর সহজপ্রাপ্যতার কারণেই জাতীয় মাছের স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই মাছ পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই ইলিশের কোনো না কোনো পদ থাকতো। কিন্তু পান্তার সঙ্গে ইলিশ হতেই হবে এমন কোনো ঐতিহ্যের কথা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। অথচ কালের পরিক্রমায় এখন যেন পান্তা এবং ইলিশই একমাত্র পহেলা বৈশাখের উদযাপনীয় আইটেম হিসেবে আখ্যা পেয়ে গেছে।

আমরা এখন ধারাতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছি। গরম ভাতে পানি ঢেলে দিয়ে পান্তা বানিয়ে সেটা মজা করে খাচ্ছি।  আর ইলিশ মাছ খেতে হবেই বলে বাজারে খুঁজে খুঁজে বিশাল দাম দিয়ে ইলিশ কিনছি। সেই সুযোগে ইলিশের দাম উঠছে আকাশে। কোথাও আবার বৈশাখে একটা ইলিশ মাছ জোগাড় করতে না পারা মানে অক্ষমতা ও ব্যর্থতা, খুব অদ্ভুত। কিন্তু কত দেশি সুস্বাদু আর কমদামি ঐতিহ্যবাহী মাছ আছে, সেগুলোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না।

বিভিন্ন গবেষণা আর ইতিহাসবোদ্ধাদের মতে, বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে এর কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদদের মতে, বৈশাখের সকালে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ খাওয়ার চর্চাটি মূলত ঢাকায় শুরু হয়। পরবর্তীতে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে পয়লা বৈখাশের প্রাক্কালে ইলিশের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। আর এই এপ্রিল মাস ইলিশের মৌসুম নয়। এই সময়ে ইলিশ পাওয়াটাও মুশকিল।

অনেকের মতে, পয়লা বৈশাখে ইলিশ নয় বরং লবণ-পান্তা-তেল-মরিচই উপযুক্ত খাবার। সঙ্গে ভর্তা বা ডিম ভাজিই যথেষ্ট। সঙ্গে দেশীয় বিভিন্ন মাছ তো রয়েছেই। এগুলো দিয়েও তো বৈশাখ হয়, আমাদের জাতীয়তা বা বাঙালিয়ানা ধরে রাখা যায়। সেখানে ইলিশ মাছ কখনোই বাধ্যতামূলক না। এটা নিছকই আমাদের তৈরি ঐতিহ্য। অনেকে আবার বলছে, ইলিশ প্রজননের এই সময়টাতে ইলিশ উৎসব হলে ইলিশের সংখ্যাই তো কমে যাওয়ার কথা।

এবার একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই। বৈশাখে যখন খরার মাস যখন কোনো ফসল হতো না তখন কৃষকদের হাতে টাকাপয়সাও থাকতো না। সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে, কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতো। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুব ছোট আকারে। একজন কৃষাণী আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ভিজিয়ে রাখতো, চাল ভিজিয়ে রাখতো। সকালে কৃষক সেই চাল পানি খেত এবং শরীরে কৃষাণী পানিটা ছিটিয়ে দিত। তারপর সে হালচাষ করতে যেত। দুপুরবেলায় পান্তা খেতে পারতো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে। কখনো কখনো একটু শুটকি, একটু বেগুণ ভর্তা ও একটু আলু ভর্তা দিয়ে খেত।

প্রতিটি হোটেল-মোটেল, পর্যটন কেন্দ্র, মেলা, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়িতে হুজুগের বশেই বিশাল দামী ইলিশ কেনা হচ্ছে। সাধারণ পান্তার সঙ্গে মিলিয়ে সেগুলো আয়েশ করে খাওয়া হচ্ছে। ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। তবে বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশ কোনোভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়।

প্রাচীন কোনো গ্রন্থেই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। নদী বহুল বাংলায় স্বাভাবিক ভাবেই মাছ খাদ্য তালিকায় অন্যতম জায়গা করে নিয়েছিল। তবে বাঙালির এই মৎস প্রীতি আর্য সভ্যতার সংস্কৃতি কোনোদিন সুনজরে দেখেনি।

হাজারো ছন্দ-কবিতা ও প্রাণের উচ্ছ্বাসে বছর ঘুরে আসে পহেলা বৈশাখ। প্রতি বছর এ দিনকে ঘিরে বাঙ্গালি জাতি আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। থাকে বিভিন্ন প্রকারের খাবারের ব্যবস্থা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নববর্ষ উৎযাপন উপলক্ষ্যে চারিদিকে ইলিশ বিক্রির ধুম পড়ে।

সুস্বাদু মাছ, জাতীয় মাছ, পছন্দের মাছ- আপনি বছরের যেকোনো সময়ে খেতেই পারেন। এটা নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই। কিন্তু বিশেষ দিবসে এই মাছই খেতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। ইতিহাসও বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নিয়ে কোনো রীতিনীতির ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে গড়ে তোলা ঐতিহ্য তো, তাই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিনা, তার ব্যাখ্যাতে আমরা কমই যাই।

বাংলা ইনসাইডার

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭