নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 10/05/2019
“শুধু তো একটি দেশ নই যে জ্বালিয়ে দেবে
প্রাচীর তো নই একেবারে ভেঙ্গে ফেলবে
সীমান্ত নই যে মুছে ফেলবে পুরোপুরি
...............
খয়রাতে সংগৃহীত ট্যাংক নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছো
দিনরাত অবিরাম নাপাম বোমা নিক্ষেপ করছো
দেখো একদিন তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে
আমার কোন হাতে শৃঙ্খল পড়াবে তুমি
আমার হাত তো আছে সাতকোটি
ঘাড় থেকে কয়টি মাথা বিচ্ছিন্ন করবে?”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কবি এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব কাইফি আজমি, ‘শিরোনামে বাংলাদেশ’ নামে এই কবিতাটি রচনা করেন। তার আসল নাম আতহার হোসাইন রিজভি । তিনি একজন ভারতীয় প্রথিতযশা উর্দ্দুভাষী কবি ও সাহিত্যিক এবং বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতা সমাজসচেতনায় ঋদ্ধ। কাইফি আজমির জন্ম ১৯ জানুয়ারি ১৯১৯, মৃত্যু মে ১০, ২০০২ (বয়স ৮৩)। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সম্পাদক এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। আজ তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।
ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে এক জমিদার পরিবারে তার জন্ম। তিনি ছাত্র জীবনে উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যে লেখাপড়া করেন। কিন্তু ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতছাড় আন্দোলনের সময় লেখাপড়া ছেড়ে দেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ অব্দি পার্টি কার্ড সযত্নে ও সক্রিয়ভাবে রেখে দিয়েছিলেন।
পার্টির আদেশেই তার মুম্বাই গমন এবং থেকে যাওয়া এই শহরে। এ সময় তিনি আলী সরদার জাফরি সম্পাদিত দলীয় পত্রিকা কাওমি জং-এ যোগ দেন। অন্যান্য উর্দু কবিদের মতই কাইফি আজমি গজল দিয়ে কাব্যচর্চা শুরু করেন। ধীরে ধীরে সামাজিক সচেতনতামূলক কাব্য রচনা করতে থাকেন। তাঁর গ্রন্থের মধ্যে আখির-ই-সাব, শারমায়া, আওয়ারা সাজদে, কৈফিয়াত, নঈ গুলিস্তাঁ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৫২ সালে গীতিকার হিসেবে মুম্বাই চলচ্চিত্রে কাজ আরম্ভ করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কাইফি আজমি একজন খ্যাতনামা কবি ও সিনেমা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের নির্যাতন কাইফি আজমিকে ব্যথিত করে। তিনি কবিতার মাধ্যমে তাঁর অনুভূতি তুলে ধরেন। কবিতা লিখে ও পাঠ করে তিনি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করেন।
তাঁর মতে, কবিতা সমাজ পরিবর্তনে বাদ্যযন্ত্রের মতো ব্যবহার হওয়া উচিত। তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ১১ বছর বয়সে। এক মুশায়রায় পড়লেন একটি গজলের গীতিকবিতা, ‘ইতনা জো জিন্দেগী মে কিসি কি খালাল পাড়ে / হাঁসনে সে হো সুকুন না রোনে কাল পাড়ে’, যা বেগম আখতারের কণ্ঠে অমরত্ব লাভ করে। তারপরে কলম আর থামেনি। বেগম আখতার তাঁর লেখায় পরে রও বেশ কয়েকবার কণ্ঠ দিয়েছেন। একবার এক মেহফিল ছিল কাইফি সাহেবের গীতি আর সেগুলি গাইলেন আখতার সাহেবা। সেখানে কাইফি সাহেব বলেছিলেন, বেগম আখতার সাহেবের গজল শোনা মানে গজল দেখা।
কবি উর্দু, ফারসি ও হিন্দী তিন ভাষাতেই ছিলেন সাবলীল, স্বচ্ছন্দগতি। একাধিক বই লিখেছেন - আখির-ই-সাব, শারমায়া, আওয়ারা সাজদে, কৈফিয়াত, নঈ গুলিস্তাঁ এবং আরো কয়েকটি।
চলচ্চিত্রজীবনের শুরু ১৯৫২ সালে শহীদ লতিফের ছবিতে গান লেখার মধ্য দিয়ে। অচিরেই হয়ে ওঠেন এক জনপ্রিয় গীতিকার। ‘শামা’, ‘কাগজ কি ফুল’, ‘শোলা অর শবনম’, ‘অনুপমা’, ‘আখেরি খত’, ‘হাকিকত’, ‘আর্থ’ প্রভৃতি নানা ছবির সংলাপও লিখেছিলেন। চেতন আনন্দের ‘হির রানঝা’র সংলাপ ছিল কবিতায়। চলচ্চিত্রের কাব্যিক সংলাপ এটা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একো বিরল ইতিহাস।
এম এস সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ ছবির সংলাপ ও চিত্রনাট্য কে ভুলতে পারে? ইসমাত চুঘতাই-এর কাহিনী থেকে নেওয়া। মনে পড়ে অবিস্মরণীয় পঙক্তিচয় – ‘আজ রাতমেঁ বহোত গর্ম হাওয়া হ্যায়/আজ রাত নিঁদ নেহি আতে’। এই ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার ও ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়াও তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন - আফ্রো এশীয় রাইটার্স লোটাস পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার, মহারাষ্ট্র গৌরব এবং সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৮০ সালে। তাঁকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য একাডেমি ফেলোশীপ (২০০২) প্রদান করা হয়। এর আগে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
তাঁর বিখ্যাত লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আউরত’, ‘মাকান’, ‘দাইরা’, ‘বাহুরুপনি’ ইত্যাদি। ‘মেরি আওয়াজ সুনো’ নামে হিন্দি ছবিতে তাঁর গান নিয়ে একটি ছবি তৈরি হয়েছিল।
পথের পাঁচালীতে ইন্দির ঠাকরুনের কণ্ঠে গান যে সব গান কখনো পুরনো গান হবে না, তার মধ্যে আছে লতা মঙ্গেশকর ও তালাত মাহমুদের যৌথ কন্ঠে ‘ডর লাগে দুনিয়া সে’ (বুযদিল), আবার লতাজির গলাতেই ‘চলতে চলতে ইয়ু হি কোহি মিল গিয়া(পাকিজা) বা ‘ঝুম ঝুম ঢলতে রাত’(কোহরা), মহম্মদ রফির গলায়, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহ ফিল মেরে কাম কি নেহি’ (হীর রঞ্ঝা) ও ‘কর চলে হাম ফিদা ওয়াতন সাথিওঁ’(হকিকত), হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’ (কোহরা) -জসবিন্দর সিং-এর ‘তুমহারে জুলফি কি সায়ে মেঁ’ ভোলা যায়? এবং আরো অনেক।
বলা বাহুল্য, নারী অধিকারের পক্ষে ও ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী সদা উদ্যত ছিল। কবি ১৯৪৭ সালে শাউখাত আজমির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের মেয়ে শাবানা আজমী ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী এবং ছেলে ভারতীয় চিত্রগ্রাহক বাবা আজমি। শাবানা আজমির স্বামী বিখ্যাত গীতিকার জাভেদ আখতার।
কাইফি আজমি ২০০২ সালের ১০ মে ৮৩ বছর বয়সে মুম্বাইতে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলা ইনসাইডার
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭