নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 11/05/2019
২৭ জুন ২০১৭, বিবিসি একটি সংবাদ প্রকাশ করলো যে ‘কবর থেকে তোলা হবে বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রকর সালভাদ্যর দালির মৃতদেহ’।
পুরো বিশ্ব অবাক! কেননা, সালভাদ্যর দালি সারা বিশ্বেই একজন অতি জনপ্রিয় এবং অসম্ভব প্রতিভাবান শিল্পী। তবে ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন বিস্ময় জাগানিয়া এবং তাঁর চিত্রের মতোই রহস্যময়। তাই সারা বিশ্বই একটু রহস্যের আশ নিয়ে অপেক্ষা করছিলো কারণটা জানার জন্য।
পরে জানা গেলো, ১৯৫৬ সালের জন্মানো এক নারী সালভাদ্যর দালির নামে একটি মামলা করেছেন এবং দাবি করেছেন সালভাদ্যর দালিই তার পিতা। কারণ তার জন্মের আগের বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে তার মায়ের সাথে এই বিখ্যাত শিল্পীর গোপন প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। মামলাকারী নারীর নাম মারিয়া পিলার আবেল মার্টিনেজ। তার জন্ম জিরোনাতে। তিনি প্রথম এই পিতৃত্বের দাবি করেন ২০১৫ সালে। তার মতে তার মা আন্তোনিয়া কাদাকুয়েস এর একটি পরিবারে কাজ করতেন। তাদের পাশের বাড়িটিতেই থাকতেন সালভাদ্যর দালি।
১৯৫৫ সালে তিনি ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে আরেক শহরে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন। মার্টিনেজ জানান, তার মা তাকে অনেকবার বলেছেন যে তার আসল বাবা হচ্ছেন সালভাদ্যর দালি। অন্যান্য লোকের সামনেও তিনি এ কথা বলেছেন। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই সালভাদ্যর দালির লাশ তুলে ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেন মাদ্রিদের এক আদালতের বিচারক। পরে অবশ্য সেই নারীর দাবি সঠিক প্রমাণিত হয়নি।
এই হলেন সালভাদ্যর দালি, মৃত্যুর পরেও মানুষকে নানান রকম রহস্যে আলুলায়িত করে যাচ্ছেন যেমন করেছেন বেঁচে থাকতে। স্পেন ও ফ্রান্স সীমান্ত কাতালোনিয়ার ফিগুয়েরাসে ১৯০৪ সালের ১১ মে সালভাদ্যর দালির জন্ম। আজ তার ১১৫তম জন্মদিন। তার পুরো নাম সালভাদোর ডোমিঙ্গো ফেলিপি জেসিন্তো দালি ই দোমেনেখ, ১ম মার্কুইস দ্য দালি দ্য পুবোল। তাঁর বাবা সালভ্দ্যর দালি আই কুসি ও মা ফেলিপা ডমেনেক ফেরেস।
দালি ছেলেবেলা থেকেই আঁকাআঁকি ভালোবাসতেন। দিন যত গড়িয়েছে ততই আঁকাআঁকি হয়ে উঠেছে তাঁর নেশা,সাধনা,সব কিছুই। বাবার ছেলেকে নিয়ে ভিন্ন স্বপ্ন থাকলেও মা ফেরেস ছেলেকে শিল্পচর্চায় উৎসাহ দিতেন। যখন দালির বয়স মাত্র ছয়,১৯১০ সালে আঁকলেন `ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস।` ৯ বছর বয়সে `ভিলাবারট্রান`। যেগুলো দালির শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মগুলোর অন্যতম।
ছবি আঁকায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা মাদ্রিদে। তখন তাঁর বয়স ছিল সতেরো। ১৯২৯ সালে তরুণ সালভাদর নিবিষ্ট হন ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম, ফিউচারিজম প্রভৃতি চিত্রধারার সাধনায়। তাঁর চূড়ান্ত খ্যাতি আসে এই সময়টাতেই। দালি হয়ে ওঠেন বিশ শতকের অন্যতম বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ এ সময়কার তাঁর একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে দালির শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুতে আধ্যাত্মিকতার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ‘দ্য সাকরামেন্ট অব লাস্ট সাপার’ ছবিটি এরই সাক্ষ্য বহন করে। মাদ্রিদ একাডেমি অব আর্টে পড়াশোনা শেষে দালি চলে যান `শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্র` প্যারিসে। প্যারিসে নিজের আঁকা একটি ছবি নিয়ে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করেন। সে সময়ের আঁকা `দ্য গ্রেট মাস্টার বেটর`,`দ্য পারসিস্ট্যান্স অব মেমোরি` প্রভৃতি ছবি তাঁকে স্যুরিয়ালিজমের অনন্য শিল্পী হিসেবে শিল্পবোদ্ধাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়।
ভাস্কর্য নির্মাণ, আসবাব ও বইয়ের অলংকরণ, ফ্যাশন ডিজাইন প্রভৃতি নান্দনিক শিল্পচর্চায় দালি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। শিল্পকলার তথাকথিত উচ্চ-নিচ ভেদ ভেঙে ফেলেছেন দালি। চলচ্চিত্র নির্মাণেও তাঁর পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের দৃশ্য পরিকল্পনার কাজ করেন তিনি। এই মাধ্যমেও যথারীতি পরাবাস্তবতা বিষয়বস্তু হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ওয়াল্ট ডিজনি, সিসিল দ্য মিল, মার্কস ব্রাদার্স এবং আলফ্রেড হিচককের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। লুই বুনুয়েলের ১৭ মিনিটের পরাবাসত্মববাদী আর্ট ফিল্মে তিনি ছিলেন সহ-নির্মাতা। পরে এই নির্মাতার সঙ্গে আরো একটা ছবি তৈরি করেন দালি।
এই দুটি ছবিই স্বাধীন পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্র আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এসব ছবিতে বাস্তবতা আর কল্পনার জগতকে জোড়া দিয়ে দালি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিয়ে যান দর্শককে। বারবার দৃষ্টিকোণ বদলে দিয়ে তিনি দর্শককে অসম্ভবের জগতে পৌঁছে দেন। তবে দ্বিতীয় ছবিটির কিছু দৃশ্য এমন বিতর্ক তৈরি করে যে শেষ পর্যন্ত- সেগুলো সেন্সরড হয়ে যায়। এর ফলে অবশ্য বাণিজ্যিক বা মূলধারার ছবির জগতেও দালির জন্য ব্যাপক আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ সময় তিনি হলিউডের আমন্ত্রণেও সাড়া দিয়েছেন। তবে, মাত্র দুটো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন সেখানে। এর একটা হলো আলফ্রেড হিচককের স্পেলবাউন্ড আর অন্যটি ওয়াল্ট ডিজনির ডেসটিনো।
ফেদেরিকো দেল সাগরাদো কোরাসন দে হেসুস গার্সিয়া লোরকার জন্ম ১৮৯৮ সালের ৫ জানুয়ারি। স্পেনের এই বিশ্বখ্যাত কবি, নাট্যকার ও নাট্য পরিচালককে ১৯৩৬ সালের ১৯ আগস্ট জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়ারা গুলি করে হত্যা করেছিল। লোরকা এবং সালভাদ্যর দালির ছিলো এক বিশেষ শৈল্পিক বন্ধুত্ব। তারা একসময় সারাক্ষণই একে অপরের কাছাকাছি থাকতেন এবং শিল্প-সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি-মানুষ প্রভৃতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। পরে বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ বা দূরত্ব তৈরি হয় কিন্তু একে অন্যের সমালোচনা তারা করে গেছেন সারা জীবনই। তবে বলা চলে লোরকার মতো বন্ধুত্ব দালির কারো সাথেই ছিলো না।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত অস্থির দুরন্ত এবং মনযোগ আকর্ষণে আগ্রহী একজন ব্যক্তি। সিগমুন্ড ফ্রয়েড দালিকে দেখে বলেছিলেন, ‘স্পেনীয়দের মধ্যে এমন ফ্যানটিক আমি আর দেখিনি’। সত্যিই অনেক বেশি ফ্যানটিক একজন চিত্রকর ছিলেন সালভাদ্যর দালি, এমনকি তিনি রাস্তায় চলার সময় লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘণ্টা বাজাতেন বলে জানা যায়। তার চোখ ছুঁই ছুঁই গোফের অদ্ভুত শেপেরও বোধয় এটাই কারণ।
অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এই শিল্পী নিজেই নিজেকে জিনিয়াস বলে দাবি করেতেন এবং প্রচারও করতেন। ৩৭ বছর বয়সে সেই আত্মবিশ্বাসেই লিখেছেন ৪০০ পৃষ্ঠার আত্মজীবনী Vie secrete de salvador Dali”। পরে এই গ্রন্থটি `দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি`নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
পৃথিবীর বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে দালির মতন বিলাসবহুল জীবন কাটিয়েছেন খুব কম শিল্পীই। এই অত্যন্ত মনোযোগপ্রেমী, সাহসী, দৃষ্টিভঙ্গির শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেয়া খ্যাতিমান স্পেনিশ চিত্রকর ১৯৮৯ সালের ২৩ জানুয়ারি স্পেনে তাঁর জন্মভূমিতে মারা যান।
বাংলা ইনসাইডার/জেএ
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭