ইনসাইড আর্টিকেল

সেবাকে যিনি স্বর্গীয় পদক্ষেপ ভেবেছিলেন!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/05/2019


Thumbnail

“ফ্লোরেন্স শহরে এক চাষার এক কুকুর ছিল, তার নাম ক্যাপ। একদিন এক দুষ্টু লোকে পাথর ছুঁড়িয়া ক্যাপের এক পা খোঁড়া করিয়া দিল। চাষা ভাবিল, `এই খোঁড়া কুকুর লইয়া আমি কি করিব? এ আর আমার কোন কাজে লাগিবে না।` শেষটায় কুকুর বেচারাকে মারিয়া ফেলাই ঠিক হইল। একটি ছোট মেয়ে, তার নাম ফ্লোরেন্স, সে এই কথা শুনিতে পাইয়া বলিল, "আহা মারবে কেন? আমায় দেও, আমি ওকে সারিয়ে দেব।" তারপর সে ক্যাপকে বাড়িতে লইয়া গিয়া তার পায়ে পট্টি বাঁধিয়া, তাহাতে ঔষধ দিয়া, সেঁক দিয়া, রীতিমত শুশ্রূষা করিয়া কয়েক দিনের মধ্যেই তাহার খোঁড়া পা সারাইয়া দিল। তখন সেই চাষা বলিল, "ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, তা নইলে আমার এমন কুকুরকে আমি মিছামিছি মেরে ফেলতাম।”

শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের এই গল্পের ‘ফ্লোরেন্স’ই হলো পৃথিবী বিখ্যাত,  আধুনিক নার্সিংয়ের অগ্রদূত, মানবতাবাদী একজন লেখক এবং পরিসংখ্যানবিদ- দ্য লেডি উইদ দ্য ল্যাম্প নামে পরিচিত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

ইতালিতে নাইটিঙ্গেল যখন বেড়ে উঠছিলেন তখন বেশিরভাগ সাধারণ মেয়েই জানতো না শিক্ষা কী? কিন্তু নাইটিঙ্গেলের পিতা উইলিয়াম ছিলেন সচেতন ব্যক্তি, তিনি মনে করতেন মেয়েদেরও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। তাই তিনি ফ্লোরেন্স ও তার বোনকে গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলেছেন।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল অত্যন্ত অভিজাত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্রিটিশ পরিবারে ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্লোরেন্স শহরের নামানুসারেই মা-বাবা তার এই নাম রাখেন। তার বড় বোনেরও জন্ম হয়েছিল ইতালিতেই।

নাইটিঙ্গেল দম্পতি বিয়ে পরবর্তী দুই বছরের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ফ্লোরেন্সের জন্মের এক বছর পরই তার বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিঙ্গেল সপরিবারে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে। তারা বসবাস করতে থাকেন ডার্বিশায়ারে। তার মা ছিলেন ম্যারি নি।

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নাইটিঙ্গেল নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী সেবাকেই পেশা হিশেবে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে মা-বাবা রাজি হননি। তাদের মনে হয়েছিলো একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে তার যে কোনো ভালো পেশায় যাওয়া উচিত। কিন্তু ফ্লোরেন্স জোর করলে অবশেষে বাবা-মায়ের অনুমতি মেলে এবং তিনি ১৮৫১ সালে নার্সের প্রশিক্ষণ নিতে উড়াল দেন জার্মানিতে। ১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৫৯ সালে তিনি নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড।

ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে যুদ্ধাহতদের সেবা। ব্রিটেনে যুদ্ধাহতদের করুণ অবস্থার রিপোর্ট আসলে নাইটিঙ্গেল ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। ১৮৫৪ সালের ২১ অক্টোবর তিনি এবং তাঁর কাছেই প্রশিক্ষিত ৩৮ জন সেবিকা, তাঁর আত্মীয় মেই স্মিথ এবং ১৫জন  ক্যাথোলিক নানসহ (সিডনী হারবার্টের তত্ত্বাবধানে)অটোম্যান সাম্রাজ্যে যান। নাইটিংগেল প্যারিসে তাঁর বান্ধবী মেরি ক্লার্কের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তাঁদের ক্রিমিয়ার ব্লাক্লাভার ব্লাক সি এর ২৯৫ নটিক্যল মাইল (৫৪৬ কিমি; ৩৩৯ মা) এলাকা জুড়ে প্রেরণ করা হয়, যেখানে ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটি ছিল।

নাইটিংগেল এরপর  ১৮৫৪ সালের নভেম্বরের শুরুর দিকে স্কুটারির (বর্তমান ইস্তাম্বুলে) অবস্থিত সেলিমিয়ে ব্যারাকে উপস্থিত হন। তাঁর দল দেখতে পায় প্রশাসনিক অবহেলার জন্য দায়িত্বের বোঝায় পৃষ্ঠ মেডিকেল টিম যুদ্ধাহতদের ভাল যত্ন নিতে পারছিল না। ওষুধের ঘাটতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রোগের সংক্রমণ প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোগীদের খাবার তৈরির বিশেষায়িত ব্যবস্থা ছিল না। যুদ্ধে আহত হওয়ার চেয়ে সেখানে রোগে ভুগেই বেশি সৈন্যরা মারা যাচ্ছিলো এবং অসুস্থ অবস্থায় পড়ে ছিলো। ফ্লোরেন্স সেখানে তাদের জন্য যথাযথ হাসপাতাল গড়ে তোলেন। আধুনিক সেবার ব্যবস্থা করেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল দিনের বেলা কাজ করে রাতে মোমবাতি হাতে আহতদের খোঁজ খবর নিতেন।

ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নেও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৫৯ সালে রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং। ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’।

নাইটিংগেল “নোটস অন নার্সিং” নামক বই লিখেছেন (১৮৫৯)সালে। এই বই নাইটিংগেল স্কুল সহ অন্যান্য নার্সিং স্কুলে পাঠ্যসূচীর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।  যদিও এটা বাড়িতে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবার জন্য লেখা হয়েছিল।

নাইটিংগেল বলেন, " প্রতিদিন পরিষ্কার থাকার জ্ঞান, অথবা নার্সিং এর জ্ঞান অন্য কথায় কিছু নিয়মাবলী, যা নিয়ে যাবে রোগমুক্ত অবস্থায় অথবা রোগ থেকে মুক্ত করবে, আরও ভাল করবে, এটা সার্বজনীন জ্ঞান যা সবার থাকা উচিত, চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে কিছুটা আলাদা যেটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষে সীমাবদ্ধ।"

পৃথিবী যেমন ফ্লোরেন্সের সেবা গ্রহণ করেছিলো, সুস্থ হয়ে উঠেছিলো তাঁর শুশ্রুষায় সেই ঋণে ফ্লোরেন্সকেও কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করে গেছে যুগ যুগ ধরে। ১৮৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদকে ভূষিত করেন। প্রথম নারী হিসেবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। বহু মনীষী তাকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন যারা এ পেশায় নতুন আসেন তারা ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে একটি শপথ গ্রহণ করে তার প্রতি সম্মান জানান। ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে, পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। আজ ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে, আজ ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন।

পৃথিবীর সকল দেশের নার্সদের জন্য নাইটিঙ্গেল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নার্সদের জানতে হবে, সেবা একটি স্বর্গীয় পদক্ষেপ, সেটা বিরক্তি নিয়ে করা যায়না। রোগী তথা বিপর্যস্তের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সমমর্মিতা থেকেই কেবল সেবিকার পেশায় নিয়োজিত হওয়া যায় তা কেবলমাত্র জীবিকার মাধ্যম হলে সেটা সেবা নয়।

১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট, ৯০ বছর বয়সে এই মহীয়সী নারী চলে যান পৃথিবী ছেড়ে প্রশান্তি নিয়ে। মৃত্যুর সময় তিনি নিজ বাড়িতেই ঘুমিয়ে ছিলেন। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে সেন্ট মার্গারেট চার্চে তাকে সমাহিত করা হয়।

 

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭