ইনসাইড আর্টিকেল

আমাদের মায়েরা কোথায় এখন?  

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 12/05/2019


Thumbnail

“মা রে, মা, তোর অনেক দোষ মা! তুই বউয়ের সাথে মিল্যা যিল্যা খাইতে পারস না মা। কেন পারস না মা? তোর তো মাইয়া নাই, অরে তুই মাইয়া ভাইবা থাকতে পারলি না? তাইলে তো আর এতোকিছু হইতো না। তোরও এতো কষ্ট হইতোনা আমারও এতোগুলা টাকা খরচ হইতোনা। তোর বড় পোলার তো একটা টাকাও খরচ হয়না মা, অয় তো খুশি রে মা। তুই কেন যে বুঝস না মা। আমার দিকটা তুই এট্টু বোঝ মা। আমার মাইয়াডা আছেনা মা? মুনিয়ারে আমি পড়ামু রে মা, আমার মাইয়াডারে নিয়া আমার অনেক স্বপ্ন রে মা। ওরে আমার বড় বানানই লাগবো। বড় ভাইরে শিক্ষিত করছস মা, আমারে কী করছস? দেখ মা আমিই আইজ তোরে টানি! আমার বউডা তোর গায়ে হাত তুলছে রে মা, তুই চিক্কুর পাইড়া কানছস, আল্লার আড়স কাইপ্পা উঠছে মা। আমার বউডা তো বেহেস্তও পাইবো না কবরে গিয়া। আমার বউরে তুইই মাপ কইরা দে মা, আমিই তো তোর চিকিসসা করাইতাছি মা, মনে কিছু রাহিস না আর......”  একটানা উচ্চস্বরে কথাগুলো বলেই যাচ্ছিলেন লোকটি। কথায় বোঝা যাচ্ছিলো তিনি সামনে বসে থাকা  অসুস্থ নারীর ছোটো ছেলে।

নিওরোলোজিস্ট দীন মোহাম্মদ এর নিজস্ব চেম্বার এসপিআরসি। একটা ছেড়া ম্যাক্সি পরে বহু পুরোনো একটা ওড়না দিয়ে গা ঢেকে হুইল চেয়ারে বসে আছেন সেই মা। মায়ের হাত-পা-শরীর শুকিয়ে কংকালসারপ্রায়। শীতের রাত, পায়ে কোনো জুতা নেই। ফ্লোরেই খালি পা রেখে মাথাটা হুইলচেয়ারের সাথে এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন, মুখ বেয়ে লালা ঝড়ছে। বয়স আনুমানিক ৫০/৫৫। এই মায়ের আশে পাশে ভিড় করে আছে দুজন সুট্যেড বুট্যেড বেশ অর্থবিত্তসম্পন্ন লোক এবং এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গো।

বেশ অনেকক্ষণ ধরে এই দুজন খুব উচ্চস্বরে বক্তৃতার মতো করে মায়ের সাথে কথা বলছে। মা কিছুই বলছে না। কোনো সারা নেই। একজনের কথা শেষ হলে আরেকজনের কথা শুরু হচ্ছে কখনো কখনো দুজন একইসাথে বলছে। মা সারা না দিলে মায়ের হাড্ডিসার শরীরে জোরে ঝাকুনি দিচ্ছে। নিরুপায় মা তখন হেলান দেয়া মাথাটা তুলে একটু সোজা করার চেষ্টা করেন আর মুখ নাড়িয়ে কিছু অদ্ভুত শব্দ করেন এবং এর সাথে সাথেই মায়ের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে......

বেশ অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটি দেখলাম, সুট্যেড বুট্যেড লোকদ্বয়ের কথা শুনলাম মনযোগ দিয়ে। তাতে বুঝলাম যে এই টাই-ঝুলিয়ে হাসপাতালে আসা লোক দুইজন হচ্ছে এই মায়েরই সন্তান। একজন কলেজের টিচার আরেকজন বিদেশ থাকেন তাই তার প্রচুর টাকা, সেই টাকায় দেশে এসেছেন পলিটিক্স করে ক্ষমতা কিনতে। এই বিদেশ ফেরত ছোটো ছেলের আয় রোজগার বেশি তাই বড় ভাই কলেজের শিক্ষিত লেকচারার তার মাকে দিয়ে দিয়েছেন ছোটোছেলের দায়িত্বে।

পূর্বে মায়ের ছোটো ছেলেটি ছিলো বেকার এবং দুষ্ট, মায়ের তাকে নিয়ে, তার ভবিষ্যত নিয়ে একটু চিন্তা ছিল তাই ছোটো ছেলেকে কিছু জমি বেশি দিয়েছে। মানে সেই জমি বিক্রির টাকায়ই ছোটোছেলেটির বিদেশ যাত্রা সফল হয় এবং এই কারণেই বড় ছেলেটি মায়ের উপর রেগে যেয়ে মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগই রাখেনি এবং ভাইয়ের সাথেও না। আর ছোটোছেলে তার বউয়ের কাছে রেখে গেছে মাকে।

এবার আসি মাকে নিয়ে ছোটোছেলের বউয়ের কাহিনীতে যেগুলো হাসপাতালে বসে আমি জানতে পেরেছি বড় ভাইয়ের বয়ানে। ছোটো ছেলেটির বিদেশ যাওয়ার কয়েকমাস পরেই এলাকার লোকজন এসে লেকচারার ভাইকে বলতেন যে ছোট বউ তার মাকে খুব নির্যাতন করে, খেতে দেয়না, কাপড় পরতে দেয়না, নিজেদের পুরোনো কাপড় পরায়, সবসময় ঝগড়া করে, মরণ কামনা করে, এমনকি কয়েকবার মায়ের গায়েও হাত তুলেছে। কিন্তু এই বড় ছেলেটি সব শুনেও সম্পুর্ণ নির্বিকার ছিলেন। এমনকি নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছালে মা নিজেই তার বড় ছেলেকে ফোন করে বলে, “আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও বাবা”। কিন্তু বড় ছেলেটি তখনও নিরুপায়ই থাকে।কিছুই করার থাকেনা তার মায়ের জন্য। এরইমধ্যে মায়ের একবার ডায়রিয়া হয়, মাকে কোনো সেবা যত্নই করেনা তার ছোটো ছেলের বউ। সেই কথা সে কেঁদে কেঁদে বিদেশে তার ছোটো ছেলেকে বলে।তখন ছেলের ধমক খেয়ে মায়ের পুত্রবধু মায়ের জন্য এমন ওষুধ এনেছেন তা খেয়ে মায়ের পায়খানা চিরতরে বন্ধ হুয়ে যাওয়ার উপক্রম।পায়খানা না হওয়াতে নাকি ছেলের বউ বেশ খুশি হয়েছে। এই খুশিতে মা তাকে আরো খুশি করে ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। এই স্ট্রোকের ঘটনা শুনে তখন বড় ভাই বিদেশে ছোটো ভাইকে ফোন দিয়ে জানান। কিন্তু জানালে কী লাভ, ছোটো ভাই তো বিদেশ।পরে ছোটোছেলের তত্ত্বাবধানে এলাকার পরিচিত কাউকে একজনকে ডেকে সদর হাসপাতালে নিয়ে মাকে একদিনের জন্য চিকিৎসা করিয়ে আনেন। এরও মাস ছয়েক পরে ছোট ছেলে বিদেশ থেকে দেশে আসে এবং মাকে নিয়ে ঢাকায় এসে নিওরোলোগির ডাক্তার দেখানোর চেষ্টা করে। চিকিৎসা চলছিলো মায়ের। কোন একটা পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছিল তারা......

এই হলো আমাদের দেশের বেহিরভাগ মায়েদের অবস্থা। আমাদের সকলেরই আশেপাশে এমন ঘটনা বহু ঘটে। ফেসবুকে মাঝে মাঝেই এমন্সব ঘটনা শেয়ার হতে দেখা যায়। কিন্তু থামে কি? না! থামেনা বরং যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই সন্তানরা মা বাবার প্রতি অশ্লীল হয়ে উঠছে। এমন এমনসব ঘটনা ঘটে কান নেয়ার ক্ষমতা রাখেনা। অথচ মা আমাদেরকে কতো ভালোবেসে জন্ম দিয়েছেন তা আর বিশদ ব্যাখ্যায় বোধয় কাউকে বলার দরকার হয়না।

এই তো গেলো সরাসরি শারীরিক অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনা, এছাড়া মানসিকভাবেও আমাদের মায়েরা থাকেন আমাদের কাছে ভীষণ অবহেলিত। দূরের গ্রামে বসে একা ঘরে কতো কতো রাত পার করে দেন ছেলেটা-মেয়েটার আশায়! কী আশায়? শুধু চোখে দেখবেন এই আশায়! ইচ্ছেমত রান্না করে খাওয়াবেন এই আশায়, পাশে বসে দু একটা কথা বলবেন এই আশায়। কিন্তু এ যুগে সেসব সময় আমাদের কারোই নাই। আমরা কেউ বিখ্যাত হতে নিজেদের সমস্ত সময় খুইয়ে ফেলছি শহরের ধুলায়, আবার কেউ টাকার পিছে ঘুরে ঘুরে মলিন করছি মায়ের মুখ। এমনও অনেককে শুনেছি যিনি বড় অফিসার হয়ে মায়ের সাথে আর কথা বলেন না, বলতে পারেন না, মা তাকে আপনি করে বলেন। বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেশে দেখার কেউ নাই চেলে বিদেশ যেয়ে বিদেশি  নাগরিকত্ব নিয়ে ফ্যামিলিসহ সেখানেই স্যাটেল! আসার সময় নেই এমনকি রেগুলার একটু খোঁজ নেয়ারও সময় নেই।

আর আমাদের নারীরা! সকল নারীই একদিন মা হবেন, তবুও এই নারীরাই মা কিংবা শ্বাশুড়ি হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বোধয় বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন না যে একজন মায়ের অনুভূতিগুলো কেমন। নিজের মায়ের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা এবং পক্ষপাতিত্ব থাকা সত্ত্বেও শ্বাশুড়ির প্রতি চরম অমানবিকতা করতে কেনো যেন তাদের বিবেকবোধ জাগ্রত হয়না। অনেক ছেলেরাই সংসারটা ভেঙ্গে যাবে এই ভয়ে মায়ের দেখাশুনা করতে পারেনা, মায়ের সেবা করতে পারেনা, মায়ের সাথে কথা বলে স্ত্রীকে লুকিয়ে। অনেক পুত্রবধুই নাতি নাতনির সাথে তাদের দাদীকে কথা বলতে দেয়না। কেবল মূর্খরাই যে এমন তা কিন্তু নয়। বরং অনেক বেশি শিক্ষিত আমরাই আধুনিকতার নাম করে এসব নোংরা ইন্ডিভিজুয়ালিজম চর্চা করি যেখানে প্রতিনিয়ত অপমানিত লাঞ্চিত নির্যাতিত হন একজন মা!  

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭