ইনসাইড থট

তারেক জিয়ার গুজব ষড়যন্ত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 15/05/2019


Thumbnail

অনেকেই বলেন দুনিয়ার প্রায় সব বাঙ্গালিই নাকি বাছ বিচার না করেই গুজবের ঘোড় সওয়ার হন। পরে ধরা খেয়ে ঠিক হন বটে কিন্তু ততো দিনে জল এতোদূর গড়ায় যে, আসল ঘটনাকেও তখন বাঙ্গালিরা গুজব বলে সন্দেহ করে ক্ষতিগ্রস্থ হন। আমাদের দেশেই শুধু না উন্নয়নশীল দেশে এমনকি উন্নত অনেক দেশেও গুজবের ডালপালায় ভর করে ঘটে যাওয়া নানা কীর্তিকলাপের কথা জানা যায় বিভিন্ন মাধ্যমে।    

‘গুজব’-তিন অক্ষরের আপাত নিরীহ একটি শব্দ। এই শব্দটি কখনো কখনো ভীষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। বর্তমান আইটির এই যুগে গুজবের গতিবেগ আলোর গতির চাইতে দ্রুত। প্রখ্যাত মার্কিন কথা সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের ভাষ্য মতে, ‘সত্য তার জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে গুজব বা মিথ্যা সমস্ত পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসতে সক্ষম।’ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার চমৎকারভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘গুজব’কে। ‘গুজব’ আসলে কি? এর আভিধানিক অর্থ – রটনা, ভুল বা অসঙ্গত তথ্য প্রচার।        

গুজব কেন এতো জনপ্রিয়তা পায়। কেন, কখন, কোন পরিস্থিতিতে গুজব ছড়ানো হয়? প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস ডিফনজো এবং প্রশান্ত বড়দিয়ার মতে গুজব ছড়ানো হয় কোন কিছুর ক্ষতি করে কিছু পাবার আশায়। তাই নিশ্চিতভাবেই আমাদের গুজব মোকাবেলা করতে হবে। কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে, হয়।  

গুজব নিয়ে সারা দুনিয়ার গবেষনার সামান্য দুই একটির তথ্য উপাত্ত এখানে তুলে ধরলে দেখা যায় যে, গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত রিউমার সাইকোলজি (Rumor Psychology) নামক গবেষণা গ্রন্থে গুজব ছড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে- ১.  অনিশ্চিত পরিস্থিতি ২. উদ্বেগ ৩. তথ্যের গুরুত্ব ৪. অস্পষ্টতা ৫ সামাজিক অবস্থান।   

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এমআইটি’র তিন জন গবেষক: সরুষ ভসুগি, দেব রয় এবং সিনান এরাল কর্তৃক সম্পন্ন এ সংক্রান্ত একটি  গবেষণাপত্র সম্প্রতি বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘সাইন্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘অনলাইনে সত্য এবং মিথ্যা সংবাদের বিস্তার’। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল অবধি টুইটারে পরিবেশিত গুজব বা মিথ্যা তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পান, উক্ত সময় কালে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার গুজব ৩০ লাখ ব্যবহারকারী ৪৫ লাখ বার টুইট করেন!

ছয়টি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান টুইট গুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করে। সমস্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এই মতে উপনীত হন যে, সত্য ঘটনা বা তথ্যের তুলনায় মিথ্যা বা গুজব প্রচারিত হয় অনেক দ্রুত গতিতে এবং তার ব্যাপ্তি অনেক প্রসারিত ও গভীর। একটি গুজব, প্রকৃত ঘটনার তুলনায় ছয় গুণ দ্রুত গতিতে মানুষের কাছে পৌঁছায়! ব্যবসা, বিজ্ঞান এবং বিনোদন সংক্রান্ত গুজব সমূহ অপেক্ষাকৃত বেশি জনপ্রিয় তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে রাজনৈতিক গুজব! গুজব দ্রুত গতিতে ছড়ানোর অন্তর্নিহিত কারণ তাহলে কী? এই তিনজন গবেষকের মতে, বিষয় বৈচিত্র্য এবং তথ্য বা ঘটনার অভিনবত্ব এর মূল কারণ। যা হোক পুরাতন দিনের কিছু গুজবের কথা এবার জেনে নেওয়া যাক।

কয়েকটি ঐতিহাসিক গুজবের উল্লেখ করা যেতে পারেঃ- ১৭৫০ সালে হঠাৎ করে প্যারিসের রাস্তা থেকে শিশুরা উধাও হয়ে যেতে থাকে। কেউ বলতে পারছিল না কী কারণে এ রকম হচ্ছে! এরকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন সবাই বিশেষ করে শিশুদের অভিভাবকেরা ভীষণ উদ্বিগ্ন; চারিদিকে রটে যায় যে, সম্রাট লুই (পঞ্চদশ) কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। এ রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় শিশুদের রক্তে স্নান করা। আর  সে কারণে রাজার লোকেরা শিশুদের অপহরণ করছে। গুজবটি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে, যার ফলে প্যারিসে সংঘটিত হয় ব্যাপক দাঙ্গা।

১৭৬১ সালের শুরুর দিকে লন্ডনে দুইটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। স্বাভাবিকভাবে লন্ডনবাসী কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন। এরমধ্যে গুজব রটে যায় যে, এপ্রিলের ৫ তারিখে আঘাত হানবে শক্তিশালী এক ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প। আতংকিত নগরবাসী পালাতে থাকে শহর ছেড়ে। যাদের বিকল্প কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলোনা তারা খোলা মাঠে অবস্থান নেয়। জনৈক সৈনিক এ ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, তিনি পুরো শহরে রাস্তায় রাস্তায় জনসাধারণকে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্বন্ধে অবহিত করতে থাকেন। দুঃখজনক ভাবে কয়েক মাস পরে ওই সৈনিকের স্থান হয় এক পাগলা গারদে।

১৮৫৭ সালে ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিলো তার মূলে ছিল একটা গুজব। তখনকার দিনে বন্দুকের কার্তুজ দাত দিয়ে খুলতে হতো। একটা গুজব ছড়িয়ে তাতে বলা হয়েছিলো যে ঐ সব কার্তুজে গরু আর শুয়রের চর্বি ব্যবহার করা হয়। এতে গোটা ভারত জুড়ে ব্রিটিশ বাহিনীতে থাকা মুসলিম ও হিন্দু সৈন্যদের মাঝে শুরু হয় বিদ্রোহ, যা দমন করতে বহু রক্তপাতের আশ্রয় নিয়ে হয় ব্রিটিশদের।    

এ কথা ভাববার কোনো অবকাশ নেই যে, গুজব ছড়ানোর প্রবণতা কেবল অতীতকালে ছিল। এমনকি বর্তমানেও ক্রমাগতভাবে গুজব রটছে এবং কখনো কখনো তা অনেক বড় আর্থিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবরে হঠাৎ করেই  ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী স্টিভ জবসের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে নেয়া  হয়েছে। খবরটি শেয়ার বাজারে ছড়িয়ে পড়তেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্কের। লেনদেনের প্রথম ঘন্টায় অ্যাপলের শেয়ারের ব্যাপক দরপতন ঘটে যার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! ঘটনাটির সূত্রপাত হয়, যখন ১৮ বছরের অজ্ঞাতনামা এক যুবক সিএনএন’ এর আই রিপোর্ট ওয়েবসাইটে খবরটি পোস্ট করে। কর্তৃপক্ষ কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই সংবাদটি পরিবেশন করে!   

৩ মার্চ ২০১৩ সাল দিনটি ছিল জামায়াতীদের তৈরি করা একটি কলঙ্কের দিন। আগের মধ্যরাতের পর হতে শুরু হয় পরিকল্পিত গুজব অভিযান। গভীর রাতে বগুড়া শহর ও শহরতলি এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যুদ্ধাপরাধের বিচারে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোওয়ার হোসেন সাইদীকে চাঁদে দেখা গেছে। ফেসবুকে কৌশলে ফটো এডিট করে চাঁদে সাঈদীকে দেখান হয়। এই ঘটনায় দাঙ্গায় ১৩জন নিহত হয় এবং আহত হয় শতাধিক নিরিহ মানুষ। 

সড়ক দুর্ঘটনায় দুই (২) ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নামের একটা সফল সুন্দর আন্দোলনের ফসল নিজেদের ঘরে নিতে ৫ ই আগস্ট ২০১৮ তারিখে ধানমণ্ডিতে সরকার বিরোধীরা এক হয়ে গুজব ছড়ায় যে, আওয়ামো লীগ আফিসে নিয়ে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। এই গুজব ছড়াতে অংশ নেয় সেলিব্রেটি, বিশ্বখ্যাত চিত্র শিল্পী সহ অনেকে। বাংলাদেশ সরকার খুব ধৈর্যের সাথে তা সামাল দেয়, যাতে জান মালের ক্ষতি না হয়।      

চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়েছে এই গুজব ছড়ায় একজন নামকরা সামাজিক আন্দোলনের নেতা, টেলিভিশনের লাইভে খুব কৌশলে, মধ্যরাতে। সাথে সাথে টাকার খেলা চলে বেশুমার। এসময় গুজবএর সফল প্রয়োগ আমরা বাংলাদেশের মানুষ লক্ষ্য করি। অল্পের জন্য সরকার রক্ষার পায় কিন্তু চরম নাকাল হতে হয় সরকারের অনেককে।          

টঙ্গীর ময়দানে তাবলীগের সাথীদের সাথে হেফাজত ও মাদরাসার ছাত্রদের মাঝে সংঘর্ষে একেরপর এক মিথ্যাচার আর গুজব ছড়িয়ে নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিছুদিন আগে বিশব এজতেমাকে কেন্দ্র করে হেফাজতি আলেমরা দেশের নানান স্থানে ব্যানার পেষ্টোন ও পোষ্টারিং এর ছবিতে তাবলীগের সাথীদের হাতে মাদরাসার ছাত্র নির্যাতনের ছবি হিসাবে হেফাজতের ৫মের ছাত্রদের ছবি, আরকানে রোহিঙ্গা মুসলমান ও আফ্রিকার মুসলিম শিশু নির্যাতনের ছবি ব্যাবহার করে সরলমনা জনগনকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশে একটি ধর্মীয় সংঘার্ত তৈরি করার চেষ্টা করা হয় বলে শক্ত অভিযোগ আছে।         

বাংলাদেশ সহ আশেপাশের অনেক দেশের এমন গুজবের কথা বলা যাবে। তাতে এই লেখার কলেবর শুধু বাড়বে। তবে এটা জানা গেছে যে, হালের নতুন ইতিহাসবিদ বলে খ্যাত জনাব তারেক জিয়া ষড়যন্ত্রের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। ব্যাঙ্গ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বললেও ডিজিটাল সব সুবিধাই তিনি নিজের স্বার্থে প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। এখন অনলাইনে নানা গুজব ছড়ানোর মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগুচ্ছেন তিনি। তার নিয়োজিত ‘জাতীয়তাবাদী সাইবার যোদ্ধা’ আর তার সাথে জামায়াতী ‘বাঁশের কেল্লা’র যোদ্ধারা মিলিত হয়ে আবার নতুন করে গুজবের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি- জামায়াত আগামী বগুড়া উপ-নির্বাচনের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের একটা পরিকল্পনার খবর পাওয়া গেছে। জিয়ার জন্মস্থান বগুড়ায় বিএনপি’র প্রভাব বেশী তাই ৩ মার্চ ২০১৩ এর আদলে শুরু হতে পারে পরিকল্পিত গুজব, সাথে নিহত আহতের ফটোশপের কারুকাজ, সোশ্যাল মিডিয়ায়। যাতে উপ-নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি খুব কম হয়। সেই ষড়যন্ত্র এখন পাকাপোক্ত। ভটের আগের দিন রাত থেকেই চলবে গুজব সন্ত্রাস ২০১৩ সালের আদলে, লাশ আর রক্তাক্ত মানুষের ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যাবে। যা দিয়ে বিএনপি জামায়াত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রকে বলতে পারেন যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা নেই। চাপে ফেলে সরকারের কাছ থেকে নিতে পারা যায় বাড়তি কিছু সুবিধা। সংসদে হৈ চৈ করবেন তাদের দলীয় সাংসদগণ। এভাবেই গুজবের সাথে সড়যন্ত্রের মিশেল দিয়ে কিছু করা ছাড়া কোন পথ নেই বিএনপি-জামায়াতের সামনে। এটাই তারেক জিয়ার সর্বশেষ পরিকল্পনা বলে নির্ভরযোগ্য সুত্রে দাবী করেছে।    

বাংলা ইনসাইডার

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭