ইনসাইড আর্টিকেল

একজন অস্ট্রেলিয়ানের বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 18/05/2019


Thumbnail

১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক জনতার মিছিলে ইপিআরের সদস্যদের  গুলিবর্ষণএর ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাটি একেবারে সামনে থেকে দেখেন নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে আসা একজন অস্ট্রেলীয়-ওলন্দাজ অফিসার।

এখন কথা হলো এই ওলন্দাজ অফিসার বাংলাদেশে কীভাবে বা কী কারণে আসলো?

মূলত এই ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় অফিসারের পিতৃভূমি ছিলো অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি বিশেষ কোনো পড়াশোনাও করেননি বা করার সুযোগ পাননি কেননা ১৭ বছর বয়সেই তাকে জীবিকার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জুতা পলিশের কাজ নিতে হয়। পরে নেন বাটা শু কোম্পানিতে কাজ। দু বছর পরে এই কাজও ছেড়ে দেন। ১৯৩৬ সালে জার্মানি কর্তৃক নেদারল্যান্ডস দখলের আগে তিনি ডাচ ন্যাশনাল সার্ভিসে যোগ দেন। পরে তিনি রয়্যাল সিগনাল কোরে সার্জেন্ট পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৪সাল পর্যন্ত তিনি এই পদেই কর্মরত ছিলেন।এরপর তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কমান্ডার হিশেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন এবং গ্রেফতার হন। কিন্তু জার্মান বাহিনী তাকে আটকে রাখতে পারেনি তিনি সেখান থেকে পালিয়ে চলে আসেন এবং জার্মানি থেকে ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষক হিশেবে কাজ করেন।

এর অনেক পরে ১৯৭০সালে তিনি আসেন বাংলাদেশে বাটা স্যু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। পরে ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে বাটা জুতার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে তিনি ঢাকার টঙ্গী কারখানায় নিয়োগ পান।

এরই মধ্যে স্বাধিকার আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে সারাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ৫মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে ইপিয়ার বাহিনী বাঙ্গালিদের উপর যে গুলিবর্ষণ করে সেটি তিনি দেখতে পান নিজের চোখেই। দেখেই তার মনে পড়ে যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের দিনগুলোর কথা...

এই অত্যন্ত চৌকশ বুদ্ধিদীপ্ত এবং আর্তের জন্য ভারাক্রান্ত ব্যক্তিত্বের নাম – ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। তার জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে, এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৮মে ২০০১ সালে। আজ তার মৃত্যুদিন। তিনি বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মানুষকে নিজের জন্মভূমির মতোই ভালবেসেছিলেন।

বাটা স্যু কোম্পানীর মত বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার।

এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে।

নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাঁকে `সম্মানিত অতিথি` হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের `নিরাপত্তা ছাড়পত্র` সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান।

এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানীদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান এর কাছে।

তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ঔডারল্যান্ড বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ।

যখন দেখলেন যে কেবল প্রশিক্ষণে কাজ হচ্ছেনা তখন তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি বাঙালি যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়।

মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ঔডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্বে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন।

এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন,

“ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত”।

ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাদের মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হন। তাই ঔডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে  পরবর্তীকালে বাংলাদেশ  সরকার তাঁকে  বীরপ্রতীক  সম্মাননায় ভূষিত করেন। বীরপ্রতিক খেতাবপ্রাপ্ত তিনিই একমাত্র বিদেশি নাগরিক।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭