ইনসাইড আর্টিকেল

প্রাগৈতিহাসিকের মানিক, শুভ জন্মদিন!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/05/2019


Thumbnail

“হাতের ও পিঠের মাংস পেশী নাচিয়া উঠিতে লাগিল। অবরুদ্ধ শক্তির উত্তেজনায় ক্রমে ক্রমে তাহার মেজাজ উদ্ধত ও অসহিষ্ণু হইয়া পড়িল। অভ্যস্ত বুলি আওড়াইয়া কাতরভাবেই সে এখনো ভিক্ষা চায় কিন্তু ভিক্ষা ন আপাইলে তাহার ক্রোধের সীমা থাকেনা। পথে লোকজন না থকিলে তাহার প্রতি উদাসীন পথিককে সে গালাগাল দিয়া বসে। এক পয়সার জিনিস কিন্যা ফাউ না পাইলে সে দোকানীকে মারিতে উঠে। নদীর ঘাটে মেয়েরা স্নান করিতে নামিলে ভিক্ষা চাহিবার ছলে জলের ধারে গিয়া দাঁড়ায়। মেয়েরা ভয় পাইলে সে খুশি হয় এবং সরিয়া যাইতে বলিলে নড়ে না, দাঁত বাহির করিয়া দুর্বিনীত হাসি হাসে। রাত্রে স্বরচিত শয্যায় সে ছটফট করে” – ‘প্রাগৈতিহাসিক’

গল্পটি বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত একটি ছোটোগল্প। এই গল্পের ভিখু চরিত্রটি সমাজের এমন একটা অন্ধকারের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে যার দৈর্ঘ্য অনেক দীর্ঘ। একজন ডাকাতের ভিক্ষুক হয়ে ওঠার গল্প এখানে মূল পট। সাথে সাথে মানুষের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনকে মানুষ কতো কৌশলে অর্জন করে নেয়, কেমন করে খুঁজে বের করে নেয় একজন মানুষ তার বাঁচার উপায় সেই বিষয়টি দেখিয়েছেন।এই গল্পে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন হিশেবে খাবারের পাশাপাশি মানিক লিবিডো বা যৌন চাহিদাকেও রেখেছেন।

এই গল্পে যৌনতা এতোটা প্রাধান্য পেয়েছেন কেননা এই গল্পটি কবির ১৯৩৭সালে প্রকাশিত একটি গল্প। এ সময় কবি মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের চিন্তা চেতনার দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত ছিলেন। এছাড়াও ইয়ুং, অ্যাডলার প্রমুখ ব্যক্তিদের দ্বারা এসময় তিনি প্রভাবিত ছিলেন, যা তার এ পর্যায়ের প্রায় সকল লেখায়ই স্পষ্ট। কিন্তু কয়েকবছর পরেই তিনি আবার চলে আসেন মার্ক্সবাদের দীক্ষাতলে। তিনি তখন তার সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলেন মার্ক্সবাদী চিন্তা চেতনা। সংগ্রামী জীবন, মধ্যবিত্তের পীড়ন, পুঁজিবাদের আগ্রাসন প্রভৃতি কেমন করে মানুষকে নেতিয়ে দেয় জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সেসব তিনি তার এই সময়কার রচনাগুলোতে নিয়ে এসেছেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়স যখন ২০/২১ বছর তখন প্রথম তাঁর লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেতে থাকে বলে ধারণা করা হয়।  কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সবই লিখেছেন কিন্তু তিনি মূলত হয়ে উঠেছেন কথাসাহিত্যিক। ১৯২৮ সালে তিনি প্রথম গল্প লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘অতসী মামী’। তাঁর অন্যান্য গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ১. অতসী মামী (১৯৩৫),২. প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭),৩. মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮),৪. সরীসৃপ (১৯৩৯), ৫. বৌ (১৯৪০/দ্বিতীয় সং ১৯৪৬),৬. সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩),৭. ভেজাল (১৯৪৪), ৮. হলুদপোড়া (১৯৪৫), ৯. আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬/দ্বিতীয় সং ১৯৫০),১০. পরিস্থিতি (১৯৪৬), ১১. খতিয়ান (১৯৪৭),১২. মাটির মাশুল (১৯৪৮),১৩. ছোট বড় (১৯৪৮),১৪. ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯),১৫. ফেরিওলা (১৯৫৩/দ্বি-সং ১৯৫৫),১৬. লাজুকতা (১৯৫৪) ইত্যাদি।

সুকুমার সেন তাঁর ছোটোগল্পের সমালোচনায় বলেন,‘ছোটগল্পগুলিতেই শিল্পী মানিকবাবুর শ্রেষ্ঠ পরিচয় নিহিত।’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন তার লেখায়। তুলে এনেছেন একেবারে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের ধারাবাহিকতা। যেখানে বেশিরভাগেই মিলেমিশে ছিলো রাজনীতি, পুঁজিবাদী আগ্রাসন ও লিবিডো চেতনা। মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ়তাকে এই সাহিত্যিক একেবারে পটে আঁকা ছবির মতন সামনে নিয়ে এসেছেন তার রচনায়। তিনি এক্সপ্রেশনিজম, অস্তিত্বের সংকট প্রভৃতিকে সাহিত্যের অলংকার ও উপকরণ হিশেবে ব্যবহার করছেন। তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক উপন্যাস রচনা করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে আছে জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), পুতুলনাচের ইতিকথা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিহ্ন (১৯৪৭), চতুষ্কোণ (১৯৪৮), সার্বজনীন (১৯৫২), আরোগ্য (১৯৫৩) প্রভৃতি।

১৯০৮ সালের ১৯মে বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার জন্মদিন। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সংসার জীবনে তিনি ছিলেন প্রচণ্ডভাবে অভাব অনটনের শিকার। হয়তো লেখলেখি না করলে তিনি বিশেষ কোন উপায়ে জীবিকা নইর্বাহ করতেন, তাহলে হয়তো চিকিৎসার অভাবে তাকে পঙ্গু হতে হতো না। কিন্তু লেখালেখি তাঁর কাছে ছিল মানুষ হিসেবে তাঁর দায়িত্ববোধ। তাই নিজের জীবন উৎসর্গ করে তিনি তার নিজস্ব চিন্তাকে পৌছে দিয়েছেন মানুষের কাছে কিন্তু নিজে ছিলেন পারিবারিক জীবনে অসহায় এবং দরিদ্র!

১৯৫৬সালের ৩ ডিসেম্বর এই গভীর জীবনাভিজ্ঞার ধারক বাহক এবং রচয়িতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭