নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: 28/05/2019
সময়টি ১৯৩৩ এর কিছু আগের! স্কুলে ক্লাস চলছে, হেডমাস্টার পড়াচ্ছেন। সকলেরই মনযোগ স্যারের দিকে, শুধু একজন ছাত্র ক্লাসে বসেই তাকিয়ে আছে শ্রেণীকক্ষের জানালা দিয়ে বাইরে। স্যার বেশকিছুক্ষণ খেয়াল করে দেখলেন ছেলেটি বাইরে তাকাচ্ছে এবং তা দেখে কলম দিয়ে বইতে কিছু আঁকছে। কাছে এসে স্যার তাকে দাঁড় করালেন এবং তার কাছ থেকে বইটি চেয়ে নিলেন। বইটি নিয়ে স্যার বইতে যা দেখলেন তাতে তিনি আর বইটি তাকে ফেরত দিলেন না। কিন্তু স্যার বই ফেরত দিলেন না দেখে ছাত্রটি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ে সে স্কুলে আসাই বন্ধ করে দেয়।
এদিকে স্যার প্রতি ক্লাসেই তাকে খুঁজতে থাকেন, কিন্তু পাননা। বেশ কয়েকদিন তাকে ক্লাসে অনুপস্থিত দেখে পরে স্যার নিজেই তার বাড়িতে তাকে খুঁজতে চলে যায়। যেয়ে তিনি জানতে পারেন যে ছাত্রটি প্রতিদিনই বাড়ি থেকে স্কুলের সময়মতো বেরোয় আবার স্কুল ছুটির সময়ে ফিরে আসে। তখন স্যার পুরো ঘটনাটি ছাত্রের বাবা মায়ের কাছে খুলে বলে এবং বইটি ফেরত দিয়ে বলে যে, আপনাদের ছেলে একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে।
এই ছেলেটি আর কে হতে পারে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ছাড়া? শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জে ১৯১৪ সালের ২৯ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
জয়নুল আবেদীন তার ছেলেবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রেরণা অনুভব করছিলেন তার চারপাশের পরিবেশ, জীবন ও বৈচিত্র্য দেখে। এই স্পৃহা তাকে মাত্র ষোল বছর বয়সেই কলকাতার আর্ট স্কুল দেখতে বন্ধুদের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য করে। এসব ঘটনায় তার মা ছবি আঁকায় তার আগ্রহ বুঝতে পারেন। তখনো জয়নুল আবেদীনের মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ হয়নি। তবুও মা নিজের গয়না বিক্রি করে টাকা দিয়ে ছেলেকে ১৯৩৩ সালে কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পাঠান।
এখান থেকেই শুরু তার শিল্প ও শিল্প চর্চার যাত্রা। ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অঞ্চলে অত্যন্ত শান্ত সুনিবিড়, ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই জয়নুলই আমাদের চিত্রশিল্পের মহাগুরু জয়নুল আবেদীন। ঢাকা আর্ট কলেজ যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট নামে পরিচিত সেটি তারই পরিকল্পনায় ১৯৪৮ সালে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের প্রথম আর্ট স্কুল। এছাড়াও বাংলাদেশে তার হাত ধরেই প্রথম শিল্পের এতো বিকাশ ঘটে।
তিনি কলকাতার আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। এবছরই মানে ১৯৩৮সালেই তিনি নিখিল ভারত চিত্র প্রদর্শনীতে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে আঁকা তাঁর একগুচ্ছ জলরং ছবির জন্যে গভর্নরের স্বর্ণপদক লাভ করেন। এর পরপরেই ১৯৪৩এর দিকে তিনি দেশে ময়মনসিংহে তার নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। এসময় উপমহাদেশের এই অঞ্চলে মানে কলকাতা ও পূর্ববঙ্গে চলছিল প্রবল দুর্ভিক্ষ। কলকাতায় দুর্ভিক্ষের প্রকোপ প্রত্যক্ষ করে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন জয়নুল। ময়মনসিংহ এসে দেখেন আরো ভয়াবহ অবস্থা এই অঞ্চলের। শিল্পীর কোমল প্রাণ মানুষের জীবনের এই অবমাননাকর অবস্থা সহ্য করতে পারছিলো না। তিনি আবার চলে গেলেন কলকাতায়। কিন্তু সেখানে যে তার জন্য আরো ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তা তিনি বুঝতে পারেননি।
কলকাতায় এসেই তিনি দেখতে পান, কলকাতার রাস্তায় ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া খাবার খাওয়ার জন্য কুকুর ও মানুষের জোর প্রতিযোগিতা চলছে। মানুষের সাথে পুঁজিবাদী পৃথিবীর এই অমানবিকতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। ইতিহাস করে তুলেছেন নিজ চোখে দেখা সেই মর্মান্তিক দৃশ্য যা পৃথিবীকে যুগের পর যুগ চোখে আঙ্গুল দিয়ে মনে করিয়ে দেবে নিজের অপারগতার কথা!। যে বসুন্ধরা তার সন্তানকে প্রয়োজনীয় অন্নটুকু দিতে ব্যর্থ তার বিরুদ্ধে এই প্রকৃতির রূপমুগ্ধ নৈসর্গপ্রেমিক শিল্পী বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এই দুর্ভিক্ষের সময় থেকেই। তারপর থেকে তিনি প্রায় সারাজীবনই মানুষকেই করেছেন তার আর্টের প্রধান বিষয় ও উপলব্ধি!
১৯৫১/৫২তে জয়নুল আবেদিন সরকারি বৃত্তি নিয়ে এক বছরের জন্য দেশের বাইরে যান। তিনি এসময় ইউরোপ ইংল্যান্ড সফর করেন। পাশ্চাত্যে তার এই সফরই বাংলাকে শিল্প চর্চায় এতোদূর নিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। কেননা ইউরোপে ও ইংল্যান্ডের নানা জায়গায় ঘুরে জয়নুল বাংলাদেশে শিল্পের সমৃদ্ধতার প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। দেশে ফিরে এসে তিনি এসব জায়গাগুলোতে উন্নয়ন করার চেষ্টা করেন। লোকশিল্পের বিষয়ে তিনি এসময়ই অধিক যত্নবান হয়ে ওঠেন। এমনকি এসময়টিতে তার নিজের চিত্রকর্মেও পরিবর্তন আসে অনেক। অত্যন্ত সাধারণ কোনো বিষয়কে প্রতীকী চিত্ররূপে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস তার এসময়কার ছবিগুলোতে পাওয়া যায়।
আমাদের দেশের শিল্প উন্নয়নে বা শিল্পচর্চার প্রসারে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া এই বরেণ্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে। তার আঁকা উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মগুলো হলো- ‘ঝড়, মই দেয়া, বিদ্রোহী গরু, পাইন্যার মা’, ‘পল্লী রমণী’, ‘আয়না নিয়ে বধূ’, ‘একাকী বনে’, ‘মা ও শিশু’, ‘তিন পল্লী রমণী’, ‘গুণ টানা’, ‘মুখ চতুষ্টয়’ ‘নবান্ন’ ইত্যাদি।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭