ইনসাইড আর্টিকেল

প্রগাঢ় নৈসঙ্গতায় পাড়ি জমানো শিল্পী, হুমায়ুন ফরিদীর জন্মদিন আজ!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 29/05/2019


Thumbnail

নিঃসঙ্গতা আর ইনফিনিটি বা অসীমকে, আরো প্রগাঢ়ভাবে বলতে গেলে মহাশূণ্যকে মাঝে মাঝেই খুব সমশ্রেণীর মনে হয়! মনে হয় ভ্রহ্মাণ্ডের মহাশূণ্যকে পৃথিবীর কেবল সেই ব্যক্তিই কিছুটা টের পান যিনি এখানে নিঃসঙ্গ থাকেন। এই নিঃসঙ্গতা কখনো কখনো বাইরে থেকেই দেখা যায় আবার কখনো কখনো ব্যক্তি নিজে ছাড়া কেউ টের পান না!

বাংলাদেশের কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর নিঃসঙ্গতা অনেকটা ইনফিনিটি পর্যায়ের বলে মনে হয়। সেটা তার ব্যক্তিগত যে প্রত্যক্ষ জীবন সেখানে নয়। কেননা তিনি ব্যক্তিজীবনে বেশ বন্ধুবৎসল ছিলেন এবং জনপ্রিয়তার কারণে কখনোই আশেপাশে মানুষের অভাব ছিলো বলে মনে হয়না। বিয়েও করেছেন দুটি। কেবলমাত্র মৃত্যুর কয়েকবছর আগে তিনি তার পারিবারিক জীবনে নিঃসঙ্গ হয়েছেন।

না, এসব নয়। মূলত এই শিল্পীর নৈসঙ্গ ছিলো প্রবলভাবে তার সমস্ত জীবনেই। যার কিছুটা ফুটে ওঠে তার চোখের চাহনিতে আর কিছুটা বসার ভঙ্গিতে। তবে এই নৈসঙ্গ তাকে তার জীবন দেয়নি দিয়েছে তার শৈল্পিক প্রতিভা।

নৈসঙ্গের সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যায় বলা হয় একজন মানুষের নানান ধরণের নিঃসঙ্গতা তৈরি হয়। তার মধ্যে প্রতিভাবান -চিন্তাশীল মানুষের একধরণের নিঃসঙ্গতার বর্ণনা আছে যা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত নৈসঙ্গ। অনেক ক্ষেত্রে এটাই তাদের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। কেউ কেউ এই নৈসঙ্গকে উপভোগ করার জন্য বাইরের মানুষের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেন আবার কেউ কেউ সেটা না পেরে খুব মাঝে মাঝে সেই নৈসঙ্গকে সময় দেন, তার সাথে সময় কাটান। শিল্পীর এই নৈসঙ্গ মূলত সে নিজেই।

হুমায়ুন ফরিদীর জীবনযাপন এবং স্থির নিঃশ্বাস নেয়ার যে ভঙ্গি তার সেসব বিবেচনায় এই শিল্পীর ক্ষেত্রেও তাই-ই মনে হয়েছে।

হুমায়ুন ফরিদী জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৫২সালের ২৯মে ঢাকার নারিন্দায়। তাঁর বাবা, এ টি এম নুরুল ইসলাম জুড়ি বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলেন বলে, বাবার চাকরির বদলির সুবাদে তাকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় বসবাস করতে হয়েছে।

কালিগঞ্জে প্রথমিক শেষ করার পর  মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে শেষ করেন মাধ্যমিক। এরপর চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকে তিনি তার উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন। ১৯৭০ এ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক কেমিস্ট্রি বিভাগে।

একবছর ভার্সিটি করতে না করতেই চলে এলো ৭১। তিনি চলে গেলেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে।  দীর্ঘ নয়মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে তিনি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি। যুদ্ধ পরবর্তী পাঁচবছর তিনি কাটিয়েছেনে একেবারেই বোহেমিয়ান জীবন। যদিও পরবর্তীতে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করেন অর্থনীতি বিভাগে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই তিনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীনের সাহচর্যে আসেন। এই প্লাটফর্ম থেকেই তার অভিনয় জীবনের শুরু যদিও ময়মনসিংহে ছেলেবেলায়ও তিনি মঞ্চে অভিনয় করেছেন বলে জানা যায়!

তবে মঞ্চ নাটকে তার জনপ্রিয়তার শুরু বা কাজের শুরুও বলা যায় সেলিম আল দীনের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়কে। এরপর থেকে সেলিম আল দীনের প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেই তিনি অভিনয় করতেন অদ্ভুতসব চরিত্রে। সেলিম আল দীন রচিত ও প্রযোজিত শকুন্তলা’, ‘ফনিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকে হুমায়ুন ফরিদীর অভিনীত চরিত্রগুলো এখনো ঢাকা থিয়েটারে কিংবদন্তি হয়ে আছে।

মঞ্চে যখন তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে তখনই বন্ধু আফজাল হোসেনের পরামর্শ, উৎসাহ ও সমর্থনে তিনি শুরু করেন টিভি নাটকে অভিনয়। হুমায়ুন ফরিদীর অভিনীত প্রথম টিভি নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ । এরপর তিনি আরো বহু জনপ্রিয় এবং আলোচিত টিভি নাটকে কাজ করেছেন।

টিভি নাটকেও যখন তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী এবং রূপালি পর্দার জগতে ভাটা নেমেছিল কিছু অসৎ লোকের হাত ধরে, ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলা সিনেমায় কাজ শুরু করেন তিনি। বলা হয়, বাংলা সিনেমাকে অশ্লীলতা এবং মূর্খতার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন হুমায়ুন ফরিদী। জানা যায় ২৫০টিরও বেশি ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক সিনেমায় কাজ করেছেন হুমায়ুন ফরিদী। তার দর্শকপ্রিয়তার কথা নতুন নয় যা বলাই বরং বাহুল্য!

আর অভিনয়ে কী করেননি তিনি! নায়ক, খলনায়ক, ভিলেন, সমস্ত চরত্রেই তাকে দেখা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে। আবেগী বাঙালি দর্শকও নায়ক রেখে ভিলেনের পক্ষে চলে যেত যদি সে ভিলেন হতেন হুমায়ুন ফরিদী। প্রতিটি সিনেমায় অনন্যসব ডায়ালগ নিয়ে আসতেন তিনি। তার বহু ভিলেন চরিত্রের ডায়ালগ আজো মানুষের কাছে পরিচিত। সে যুগের বাংলা সিনেমার যারা দর্শক তাদের অনেকেরই এখনো মুখস্ত আছে সেসব ডায়ালগ।

এবারে যদি তার ব্যক্তিগত জীবন পর্যালোচনায় আসি, সেখানে দেখা যায় তিনি দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীকেও ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন কেবলমাত্র বেলী ফুলের মালা দিয়ে। পরবর্তী স্ত্রীকেও বিয়ে করেছেন ভালোবেসে কিন্তু বেলী ফুলের মালা দিয়ে নয়! ২২বছর সংসার করলেন পরবর্তী স্ত্রী অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফার সঙ্গে। এরপর আবার বিচ্ছেদ।

এই যে বিচ্ছেদ! এ বিচ্ছেদের কারণই হলো তার নিঃসঙ্গতা। তিনি নন। সূবর্ণা মোস্তফা বলে থাকেন যে, “বন্ধুত্ব আর সম্মান না থাকলে সংসার করার মানে হয়না”। তাহলে তো এটি আরো সত্য হয়ে ওঠে যে সুবর্ণা মোস্তফার সঙ্গে আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হুমায়ুন ফরিদী রাখতে পারেননি তার সেই নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণাতেই।  কেননা যে কোন শিল্পীর জীবনে তিনি যে শিল্পচর্চা করেন তার মধ্য দিয়ে কিছু একটা খুঁজে বেড়ান। এই খোঁজের মাধ্যমই হলো শিল্প। সকল মানুষের মধ্যেই এই খোঁজের প্রবণতা রয়েছে কিন্তু সকলেই সে মাধ্যম খুঁজে পান না। যিনি খুঁজে পান তিনি শিল্পী।

শিল্পীর জীবনে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে, অনেকক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ ভালো মানুষ হয়েও সম্পর্কের জটিলতায় শিল্পীকে নিষ্ঠুর হিসেবে দেখা যায়। মূলত শিল্পী তার নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেন না, তার ভেতরকার একাকিত্বই শিল্পীকে নিয়ন্ত্রণ করে যা তার অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিত্বেরই স্বরূপ! তিনি যা খুঁজতে থাকেন কিছুতেই, কোনো সঙ্গেই যখন তিনি সেটা পান না, তখন তিনি বিকল্প খুঁজতে থাকেন। আর এই বিকল্পগুলো সবসময় তার জন্য মঙ্গলজনক হয়না।

হুমায়ুন ফরিদীরও হয়নি। তিনি ২২বছর ধরে সংসার করার পর পূণরায় বিচ্ছেদের মতোন ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায় তিনি এ সময় অনেক বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। হ্যা, এসময় তিনি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সকল দিক থেকেই তার নিঃসঙ্গতা তার সেই আকাঙ্ক্ষা তার সেই আপনার আপনকে পেয়েছেন। কেননা একজন শিল্পী হিসেবে তিনি সকল সময়েই এই নিঃসঙ্গতাকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন যা তাকে পরিপূর্ণরূপে নিজের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ করে দেবে। সে আরাধ্যকেই তখন তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন বলে মনে হয়,  যে কারণে তিনি অন্য সকলের থেকে দূরে থেকেছেন।

আর পৃথিবী থেকে যখন একজন মানুষের আর কিছুই নেয়ার কিংবা দেয়ার থাকেনা তখনই তিনি চলে যান নিশ্চুপে। হুমায়ুন ফরিদীও তার ৬০বছর বয়সে ২০১২ সালের ১৬ফেব্রুয়ারি (বাংলায় ফাগুন চলছিল তখন) পৌঁছে যান এই দায়হীনতায় যা তাকে তার মহাশূন্যের শান্তিতে ঘুম পাড়িয়েছে।

বাংলা ইনসাইডার/জেএফ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭