ইনসাইড থট

শেখ হাসিনা এবং এক দশরথ মাঝি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 08/06/2019


Thumbnail

যে লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় সেই লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি বঙ্গবন্ধুর খুনী ও তাঁর উপকারভোগীরা। তাই তো একই লক্ষ্যে আমাদের দেশে ঘটানো হয় ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ঘটনা, আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে বাকশাল করা, ১৯৮৬ সালে ১৫ দল ও ৭ দলের যৌথ নির্বাচনে শেখ হাসিনার সাথে বেইমানী করা, ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ওয়ান এলেভেনে মাইনাস ফর্মুলা প্রনয়ন, ইত্যাদি অনেক আয়োজন। সাম্প্রতিক কালে জোটের অন্যতম শরিক জাসদের উল্টাপাল্টা কথা বলা, রাশেদ খান মেননের সরকারের বিরুদ্ধে হুংকার, দলত্যাগী আওয়ামী লীগারদের দলে ফেরার জোর তদ্বির সবই এক সুত্রে গাঁথা।

৭ জুন ঐতিহাসিক ছয়দফা দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে ৭ই জুনের শহিদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ইনশাআল্লাহ্, ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে হবে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি কঠিন চ্যলেঞ্জের মধ্যে দিয়ে খুব সুচিন্তিত কৌশলে তাঁর দল ও দেশকে রক্ষার প্রানান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭ মে বৃহস্পতিবার ১৯৮১ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দীর্ঘ নির্বাসন থেকে দেশে ফেরেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফেরা মোটেই সবার কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। তৎকালীন সরকার বাদেও নিজ দলের অনেক নেতাই চাননি বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরে আসুক। ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে একটু পিছনে ফেরা দরকার। দেখা যাক কারা কী কী করতে চেয়েছেন, আর কতটুকু সফল হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তৎকালীন অবৈধ রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের সমর্থন আদায় করে তার ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দান করার উদ্দেশে ১৯৭৫ সালের ১৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভা আহ্বান করে। বঙ্গভবনে আহূত এই সভায় যোগদান নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ডা. এসএ মালেক ও শামসুদ্দিন মোল্লাসহ মাত্র জনাদশেক সংসদ সদস্য মোশতাক আহূত বৈঠকে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। সে সময় প্রবীণ নেতাদের মধ্যে ইউসুফ আলী, সোহরাবউদ্দিন, প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, চিপ হুইপ আবদুর রৌফ ও হুইপ রাফিয়া আকতার ডলি প্রমুখ বংগবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানী করে মোশতাকের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সময় মাত্র ৬ জন বড় ও মাঝারী সারির নেতা তাঁকে দেশে আসতে চরম সাহস যোগান, সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। কিন্তু দলের অভ্যন্তরের যড়যন্ত্রকারীরা একই সঙ্গে শেখ হাসিনার সাথে আবার সেই সময়েই ক্ষমতাসীর সরকারের এজেন্ট হয়ে কাজ করতে থাকে। এর আগে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধী আর সদ্য স্বাধীন দেশের বিভিন্ন অপরাধে যাদের বঙ্গবন্ধু জেলে নিয়েছিলেন তাদের জিয়া সরকারের আমলে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগকে রুখে দেবার জন্য। এখানেই শেষ নয়, মফঃস্বলে সফরকালে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো না সরকারের সাথে দলীয় কুচক্রীদের যোগসাজশে। তাই অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের ঠিক করা ছাত্রলীগ, যুবলীগের করমীরা তাঁর নিরাপত্তা কাজে থাকতেন। ফুড পয়জনিং করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনাও তারা নিয়েছিলো। তাই ১৯৮১ পরবর্তী সময়ে মফঃস্বলে সফরকালে, বেশ কয়েক বছর মফঃস্বলের কয়েকটি জেলার নির্দিষ্ট কয়েকটি বাড়ি থেকে তাঁর খাবার আনা হতো, একাধিক জেলা পেরিয়ে। যারা ১৯৮১ পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী থাকতেন তাঁরা এই কথার প্রমান জানেন।

এরশাদ সরকার তখন ক্ষমতায়। সারা দেশে তখন সামরিক শাসন। সারা দেশ শাসনে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা হয়। ঢাকা অর্থাৎ ‘ক’ অঞ্চলের সামরিক শাসক ছিলেন মেজর জেনেরেল আব্দুর রহমান। ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী তৎকালীন বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাসদ, বাসদ, তুখোড় বামপন্থী কিছু দলের নেতা ‘ক’ অঞ্চলের সামরিক শাসক ছিলেন মেজর জেনেরেল আব্দুর রহমান সাহেবের সাথে মিলে একটা ক্যু করার পরিকল্পনা করেন। ডাকসু তখন আখতার বাবলুর দখলে। বাবলুর কাজ ছিল কিছু লাশ ফেলে দেওয়া শিক্ষা ভবনের সামনে, আর সেই উছিলায় হয়ে যাবে ক্ষমতার পালা বদল। খবরটি বভিন্ন গোয়েন্দা সুত্রে আগেভাগের এরশাদ সাহেব জেনে যান তাই নিরীহ ছাত্রদের লাশ পড়লেও ক্ষমতার পালাবদল হয়না। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়ে ওই দিন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। বিশাল এক মিছিল সচিবালয়ের অভিমুখী যাত্রা করে স্মারকলিপি পেশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। মিছিলটি পুলিশের দ্বারা বাধা-প্রাপ্ত হয় হাইকোর্ট-মোড়ে। পুলিশের বসানো কাঁটাতারের উপর উঠে পড়ে অনেকে। জ্বালাময়ী সব স্লোগানে ঢাকা কেঁপে ওঠে। হঠাৎ করেই মিছিলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ, নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস আর ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। ভিতরে ভিতরে নিজেদের গুলির আঘাতে প্রাণ হারায় জয়নাল। আহত হয় জাফর, আইয়ুব, কাঞ্চনসহ আরো অনেকে। শিশু একাডেমীতে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে জীবন হারায় শিশু দীপালি সাহা।

এই ঘটনার পরে শাহাবাগে পুলিশ কন্ট্রোল রুমসহ আরো কিছু স্থানে আসতে হয় কিছু বড় বড় রাজনৈতিক নেতাকে। মুচলেকায় প্রাণ ভিক্ষা পান অনেক নেতা তার ফলশ্রুতিতেই ১৯৮৪ সালে গঠিত হয় বাকশাল, আপাত দৃষ্টিতে কোন কারণ ছাড়াই ভাঙ্গে জাসদ, বিএনপি ভেঙ্গে শাহ আজীজ-মাঈদুল ইসলাম মুকুল-মিনহাজুর রহমান আলোর নেতৃত্বে হয় নতুন বিএনপি, বাবলুর সাহেব দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন জাতীয় ছাত্র সমাজ গঠনের, রাতারাতি অফিস নেওয়া ধানমণ্ডি২ নং রোড আর আর এলিফেন্ট রোডের মড়ে পুলিশ বক্সের পিছনের ভবনে। তুখোড় বামপন্থী নেতা তার দল এতো ছোট যে, তিনি মুচলেকায় লেখেন যে, পরবর্তী নির্বাচনে তিনি বিরোধী দলে থেকে বিরোধী দলের সরকার বিরোধী আন্দোলনকে এরশাদের পক্ষে এনে দেবেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল আর বিএনপি’র নেতৃত্বে ৭ দলের আন্দোলনেরর ফলে যখন এরশাদ সাহেব নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন তখন ১৫ দল ও ৭ দল জোটবদ্ধ হয়ে ১৮০ -১২০ আসনে নির্বাচনে যেতে সম্মত হয়। যখন আসন বন্টনের সবকিছু চূড়ান্ত তখন ছোট দলের তুখোড় বামপন্থী নেতা তার বোন যিনি খালেদা জিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ তাঁকে দিয়ে খালেদা জিয়াকে ম্যানেজ করেন। আবার ধান্মন্ডি ৩২ নং এসে ছোট দলের বাম নেতা, জাসদ নেতা আর বাকশাল নেতা নির্বাচনে যাবার বিরোধিতা করে বসেন আচমকা। এটা আর কিছুই না সব ছিল ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মুচলেকার বাস্তবায়ন। পরে মেজর জেনেরেল আব্দুর রহমান সাহেবের বিতর্কিত মৃত্যু হয়। এরশাদ সাহেব এখনো জীবিত, তাই তাঁর কাছে এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করা যাতে পারে।

২০০৭ সালের জানুয়ারী মাসের ১১ তারিখে শেখ হাসিনাকে মানাস করার ক্ষেত্রে সেই একই মুখ ঘুরে ফিরে আসে, সাথে কিছু নতুন মুখের যোগ হয়েছে মাত্র যারা আগেও ছিলেন গোপনে। তার আগের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় কারা ইন্ধন দিয়েছে, শেখ হাসিনা তাদের চিনে রেখেছেন। আস্তে আস্তে তিনি তার পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছেন। তিনি জানেন যে, তাড়াহুড়োতে তাঁর নিজের এবং দলের ক্ষতি হবে। তাই তাঁর এই ধীরে চলা নীতির কারণেই দলত্যাগী আওয়ামী লীগাররা এতো সহজেই আর দলে যোগ দিতে পারছেন না। যারা বিভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করেছেন তাদের পারিবারিক সংস্কৃতি ভিন্ন। তাঁরা শেখ হাসিনার ক্ষতি হবে জেনেই মাঝে মধ্যে এমন সব বেফাঁস কথা বলেন বা কাজ করেন যার দায় এসে পড়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘাড়ে বা তার উন্নয়ন পরিকল্পনা হয় বাধাগ্রস্থ। মাশারাফির হাসপাতাল ইস্যু, আড়ংগে অভিযান পরিচালনাকারীকে স্ট্যান্ড রিলিজ, ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে তেলেসমাতি অনেকের মধ্যে কিছু উদাহরণ। ইদানিং তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিদেশ গেলেই বা যাবার প্রাক্কালে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়, ‘যদি লাইগা যায়’, এই আশায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার পিতার লক্ষ্যে ইস্পাত দৃঢ় অবিচল, তাই কোন বাঁধাই তাঁর কাছে আর বাঁধা থাকে না। পিতার অঙ্গীকার তাঁর কাছে এবাদত হয়ে যায়। এই কথায় একটা সত্য ঘটনা মনে পড়ে যায়।

নাম তাঁর দশরথ মাঝি। বিহারের কয়লা খনিতে কাজ করতেন তিনি। একদিন গ্রামের পাশের পাহাড় পার হতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মারাত্মক আহত হয় তার স্ত্রী ফাল্গুনী। হাস্পাতালে যেতে পাহাড় ঘুরে পথ হতো ৪০ মাইল। তাই এতো পথ ঘুরে গিয়ে আর ফাল্গুনীকে বাঁচানো যায়নি। প্রাণ হারায় দশরথের স্ত্রী ফাল্গুনী। তখন তাঁর সম্বল মাত্র ৩টি ছাগল। দশরথ তা বিক্রি করে কিনলেন গাইতি, শাবল, ইত্যাদি। পণ করলেন পাহাড় কেটে রাস্তা বানবেন। অনেকেই তাঁকে পাগল বলতো, তখন। কিন্তু দশরথের ২২ বছরের একক শ্রমে, বিহারের গেহলর পর্বতের মাঝ দিয়ে নির্মিত হয় ৩৬০ ফুট লম্বা, ৩০ ফুট উঁচু ও ২৫ ফুট চওড়া রাস্তা! ৪০ মাইল রাস্তা কমে হয়ে যায় ১ মাইলে। কতখানি ভালোবাসা থাকলে এটা করা যায়, ভেবে কূল কিনারা পাওয়া যায় কি?

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭