ইনসাইড আর্টিকেল

সুফিয়া কামাল: নারীমুক্তির অনন্য পথিকৃৎ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 20/06/2019


Thumbnail

অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে

সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে

দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার

বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়

দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।

(‘সাঁঝের মায়া’ কবিতার অংশবিশেষ)

লাইনগুলো পড়ে যেন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে হয়। চোখের সামনে প্রকৃতির সঙ্গে ভেসে ওঠে অতি পরিচিত, সরল একটি মুখ। তিনি আমাদের এক গর্বের নাম, কবি সুফিয়া কামাল। আজ তার জন্মদিন। এই জন্মদিনে তার জন্য ভালোবাসা।

এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্ম বরিশালের আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে শায়স্তাবাদে, ১৯১১ সালের ২০ জুন। পিতা সৈয়দ আবদুল বারী তখনকার একজন খুব নামকরা উকিল ছিলেন। কিন্তু পিতার স্নেহ খুব বেশি পাননি তিনি। সুফিয়ার সাত বছর বয়সেই বাবা গৃহত্যাগী হন। ফলে পিতার অনুপস্থিতিতে মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন স্নেহ-ভালোবাসায় গড়ে তোলেন সুফিয়া কামালকে।

সুফিয়া কামাল নামটির সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য আবেগ, অনুভূতি, ভালোলাগা, ভালোবাসার সরলতা ও নারীর আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার তীব্র মনোবল। তিনি শুধু কবিই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, সমাজসেবক, শিক্ষক ও সংগ্রামী নেতৃত্ব । তার কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি লাইনে মিশে রয়েছে প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বেদনাময় স্মৃতি, স্বদেশের প্রতি মমতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা এবং ধর্মীয় আবেগ।

অতি আবেগী ভাষার প্রয়োগ আর শব্দচয়নের মননশীল ব্যবহার তার প্রতিটি লেখাকে করেছে সবার চেয়ে আলাদা। তার লেখার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ কাহিনী, ডায়েরি, ছোটগল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষ গ্রন্থ। সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। উল্লেখযোগ্যের মধ্যে রয়েছে কেয়ার কাঁটা, মায়া কাজল, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী, অভিযাত্রিক, ভ্রমণ কাহিনী ‘সোভিয়েত দিনগুলি’, স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের ডায়েরি’ ইত্যাদি।

ই মানুষটির জীবনের শুরুর দিকটা একদমই আনন্দের ছিল না। নারীরা তখন সমাজে পশ্চাৎপদ। কিন্তু সুফিয়া কামাল চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে জীবন কাটানোর জন্য প্রস্তুত হতে চাননি তিনি। তখনকার সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। কিন্তু তার অনুপ্রেরণা হয়ে পাশে ছিলেন মা সৈয়দা খাতুন। রক্ষণশীল পরিবার বলে ঘরে মেয়েদের পড়ালেখা নিষিদ্ধ ছিল। মায়ের হাত থেকেই প্রথম বই পাওয়ার আনন্দ পান তিনি। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজের চেষ্টায় বাংলায় লিখতে পড়তে শিখেন তিনি। গৃহবন্দী জীবনে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে থাকেন কবি সুফিয়া।

সুফিয়া কামালের জীবনের দিক পরিবর্তন হয় মূলত বাংলার মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে। ১৯১৮ সালে মায়ের সাথে যখন প্রথম কলকাতায় যান তিনি, তখন তার পরিচয় হয় বেগম রোকেয়ার সঙ্গে। বেগম রোকেয়ার দর্শন, নারী জাগরণের মনোভাব এবং সাহিত্যানুরাগ নাড়া দেয় শৈশবের সুফিয়াকে।

কলকাতায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও তার আলাদাভাবে সাক্ষাৎ হয়। তিনি সুফিয়া কামালের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন। ১৯২৬ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় ‘বাসন্তী’ কবিতাটি প্রকাশের মাধ্যমে বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে সুফিয়া কামাল কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

‘আমার এ বনের পথে

কাননে ফুল ফোটাতে

ভুলে কেউ করত না গো

কোনদিন আসা-যাওয়া।

সেদিন ফাগুন-প্রাতে

অরুণের উদয়-সাথে

সহসা দিল দেখা

উদাসী দখিন হাওয়া।’

(‘বাসন্তী’ কবিতার অংশবিশেষ)

১৯২৯ সালে বেগম রোকেয়ার মুসলিম মহিলা সংগঠন ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’ এ সুফিয়া কামাল যোগদান করেন। এখানে নারীদের উন্নতি, শিক্ষা এবং সংস্কারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হতো। সুফিয়ার জীবনে বেগম রোকেয়ার এমনই প্রভাব ছিল যে বেগম রোকেয়ার সামাজিক আন্দোলনে সবসময় তার পথ অনুসরণ করে গেছেন। এছাড়াও তিনি রোকেয়ার উপর অনেক কবিতা রচনা করেন এবং পরবর্তীতে ‘মৃত্তিকার ঘ্রাণ’ নামে একটি কাব্য সংকলনও উৎসর্গ করেন। ১৯৩৭ সালে সুফিয়া কামালের গল্পের সংকলন ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়। পরের বছর তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’ প্রকাশিত হয়, যার প্রস্তাবনা লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুফিয়া কামালের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এরপর থেকেই সুফিয়া কামালের কবি হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

তবে তার জীবনেও এসেছে অনেক চড়াই উৎরাই। তাকে নিরন্তর যুদ্ধ করতে হয়েছে পশ্চাৎপদ সমাজ এবং ঘুণে ধরা সংস্কৃতির সঙ্গে। স্বামীর মৃত্যুর পরে সন্তানকে নিয়ে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। ১৯৪১ সালের শেষ পর্যন্ত তিনি এই পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। এই স্কুলেই পরিচয় হয় খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির এবং পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের সঙ্গে।

১৯৩৯ সালে দিকে কবি চট্টগ্রামের লেখক ও অনুবাদক কামালউদ্দীন আহমদকে বিয়ে করেন। সেই থেকে তিনি ‘সুফিয়া কামাল’ হয়ে ওঠেন। কবির সংগ্রামী জীবনের পথে স্বামী কামালউদ্দীনকেও নিরন্তর কাছে পেয়েছেন। কিন্তু তিনি মারা যান ১৯৪২ সালে

সুফিয়া কামালের সারাটি জীবন কেটেছে নারীদের স্বাধীনতা এবং নারীদের শোষণ বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টায়। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ধর্মীয় দাঙ্গায় তিনি কলকাতার সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ এলাকাই লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে একটি আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করেন। ১৯৪৯ সালে বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থের প্রধান চরিত্র সুলতানার নামানুসারে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

১৯৪৮ সালে সমাজসেবা ও রাজনীতি হয়ে ওঠে সুফিয়া কামালের সবকিছু। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত শান্তি কমিটিতে যোগ দেন তিনি। ঐ বছরই তাকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সুফিয়া কামালের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসনের কারণে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কবি সুফিয়া কামাল এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ যা বর্তমানে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নামে পরিচিত, তার হাত ধরেই গঠিত হয়। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি এবং দুস্থ পুনর্বাসন সংস্থা, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং নারী কল্যাণ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠার সাথেও সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবিও তোলেন কবি সুফিয়া কামাল।

সুফিয়া কামাল ৫০টিরও অধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক উল্লেখযোগ্য। সুফিয়া কামালের কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ৮৯ বছর বয়সে ঢাকায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তাকেই প্রথম পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

তিনি এবং তার যাবতীয় সৃষ্টি ও অবদান আজীবন বেঁচে থাকুক আমাদের হৃদয় গহীনে। জন্মদিনে এই কামনাই রইলো। 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭