ইনসাইড আর্টিকেল

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া আর সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন হচ্ছি আমরা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 28/06/2019


Thumbnail

“আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে,
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে!”

সত্যিই হারিয়ে গেছে আমাদের মায়ের সোনার নোলক- আমাদের জাতীয় চেতনা, আমাদের সামষ্টিক ঐক্য, আমাদের বাঙ্গালির একাত্মতা-আন্তরিকতার ঐতিহ্য সমস্তই হারিয়ে গেছে। সোনার নোলকের পরিবর্তে বাংলা মা পরিধান করেছেন সোশ্যাল সাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নামক হরেক রকম অলংকার! যার ঝলকে আমরা আর সুস্থ দৃষ্টিতে কিছু দেখতে পাইনা, এসব অলংকারের ঝনঝনে আর কিছু শুনতেও পাইনা আমরা! কোনো ঘটনাই আর আমাদের কাছে নতুন বা বিস্ময়কর নয়, তবুও নতুন নতুন বিস্ময় খুঁজে মরি আমরা স্যোশাল সাইট নামক অনলাইনের জগতে।

কিছুদিন আগেই আমার বাসার পাশের ভবনে একজন বৃদ্ধ মারা গেছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলেই দেখি আমার বেডরুম থেকে তিন/চারহাত দূরের সেই ভবনের সকলে মলিন মুখে বসে আছে। বেশিরভাগই ফোনে কথা বলছে, ব্যস্ত। লাশটি পাশেই কফিনে সাজানো।

বেশকিছুক্ষণ এই দৃশ্যটি দেখলাম, মনে পড়লো এই ঢাকা শহরে না হয়ে গ্রামে কেউ মারা গেলে আমরা কী করতাম। পাশের বাড়ির কেউ মারা গেলে আমরা সেদিন স্কুলে যেতাম না, আমাদের সেদিন কেউ কারো কোনো খোঁজ নিতো না, কোনো শাসন নেই, পড়তে বসা নেই, খাবারের জন্য জোর করা নেই। সকলেই যেন নিজের মতো করে মৃত্যুশোকে ভীষণ মুহ্য হয়ে পড়তো। একবার এলাকার একজন ভীষণ ভালো মানুষ মারা গেছেন বলে আমাদের হাফ-স্কুল হয়েছিল। কিন্তু তিনি খুব বেশি ধনী বা প্রভাবশালী ছিলেন না।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আর সেরকম নেই। এখন গ্রামে গঞ্জেও পৌঁছে গেছে মানুষের সমস্ত ইমোশন কন্ট্রোলার-ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর খুব সহজে, সহজ ভাষায় বন্ধুদেরকে জানিয়ে দেই আমরা। মৃত বাবা-মায়ের ছবিও আপলোড করতে ছাড়িনা অনেকেই। অসুস্থ মা-বাবা থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনের ছবি আপলোড করি ফেসবুকে- ইন্সটাগ্রামে। চোখের সামনে যেকোনো ধরণের ঘটনা ঘটলেই আমরা তাঁর ভিডিও করা শুরু করি, ছবি তুলি, ফেসবুকে ছেড়ে দিই কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই। আমাদের শুধুই ভাইরাল হওয়ার লক্ষ্য।

নারীবাদ, প্রতিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আবার নাস্তিকতা, সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গান, সবকিছুই ফেসবুকে হচ্ছে! যে মেয়েটা সমাজের কোনো ধরণেরই রাজনীতি বুঝলো না, সমাজনীতি বুঝলো না, সেও ফেসবুকে চিৎকার করতে থাকে দিনের মধ্যে দশবার যেকারো বিচার চেয়ে কিংবা যে কারো ক্রসফায়ারের দাবিতে।

যে মেয়ের সাথে পাবলিক বাসে ঝামেলা হলো কোন পুরুষের সে সেখান থেকে চুপচাপ চলে এসে ফেসবুকে লাইভে কেঁদে কেঁদে জানায় দেশবাসীকে।

কোনো ছেলের কোনো মেয়ের সাথে কোন ঝামেলা হলো, সেই মেয়ের আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও আপ্লোড করে দেয় ফেসবুকে!

ফেসবুকে প্রতি সপ্তাহে, প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে একটা করে ভাইরাল নিউজ, ঘটনা, পোস্ট নিয়ে মেতে থাকে সারাবাংলা!

আমরা আজকাল কোথাও পারিবারিক ট্যুরে ঘুরতে গেলে সবসময়ই সবাই যার যার মতো মোটামুটি ব্যস্ত থাকি ট্যুর থেকে ফিরে পরের একমাস অন্য ট্যুরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ফেসবুকে আপলোড করার ছবি তুলে নিতে,  সেগুলো আপলোড দিতে, এডিট করতে এবং চেক ইন দিতে। ভুলে যাই কাছের মানুষেরা একান্তে নিজেদের সঙ্গ উপভোগ করতেই আমরা প্রকৃতির সান্নিধ্যে বা চেনা গণ্ডি থেকে বাইরে কোথাও যাই!

আমরা ভুলে যাই পৃথিবীর কোনো তত্ত্বই সত্য নয়, আবার কোনোটাই মিথ্যেও নয়! এসব নিয়ে নিজস্ব বিশ্বাস বা মতামতের চিরন্তন কোন রূপ দেয়া কোনো যুক্তিসঙ্গত কাজ নয়।

আমরা ভুলে যাই পৃথিবীতে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটাও এরকমই, চরম সত্য অথচ স্বীকার্য না হলে অর্থহীন। জীবনের সমস্ত ঘটনাকে আমরা ফেসবুকময় করে তুলছি ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু এভাবে ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি স্বাধীনতাই।

কেউ কাউকে টিজ করছে সেই ভিডিও, কেউ কাউকে হ্যারাস করছে সেই ভিডিও, কেউ কাউকে খুন করছে সেই ভিডিও, কেউ কাউকে মারছে সেই ভিডিও, কেউ কাউকে চুমু খাচ্ছে সেই ভিডিও, কেউ হাস্যকর কিছু করছে তার ভিডিও, কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসহায় হয়ে কাঁদছে তার ভিডিও, বাস এক্সিডেন্ট করলে তার ভিডিও, ট্রেন এক্সিডেন্ট করলে তার ভিডিও, কোথাও আগুন লাগলো তার ভিডিও, কারো গোসলের গোপন ভিডিও ইত্যাদি ভিডিওতে সয়লাব এই ফেসবুক নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

কিন্তু এসব ভিডিও করার আগে যে একজন মানুষের কিছু মানবিক দায়িত্ব থাকে, সেসব ভুলে যাচ্ছি আমরা।

এসবের উদ্দেশ্য কী মূলত? এসবের কারণই বা কী? কী বা কতোটুকু লাভ আছে একটা জাতির এসবে আর কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা এসব কারণে!

হ্যা, স্যোশাল মিডিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে ফেসবুকের ইউজার সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পৌঁছে গেছে এই ফেসবুক। এসব অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার যেমন জানে না, তেমনি অনেকেই প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার শো-অফ, মেয়ে পটানো, কাউকে হ্যারাস করা, ইত্যাদি নেতিবাচক কাজে এটি ব্যবহার করে থাকে। তরুণ ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দেখা যায়, ইনবক্সের গোপনীয়তার কারণে একইসাথে অনেকগুলো প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছে। কিন্তু সেসব সম্পর্ক আর ইনবক্সে সীমাবদ্ধ রাখতে আপ্রছেনা, বাইরে বেড়িয়ে আসছে, এসব নিয়ে সমাজে কোন্দল, দলাদলি, টিজিং, র‍্যাপ এমনকী হত্যার ঘটনাও খুব সহজ খবর বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায়।

হ্যা, ফেসবুকের প্রচারণার মাধ্যমে বর্তমানে রক্তদান আমাদের দেশে একটা সুন্দর, মানবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুকে ইভেন্ট চালু করে অনেক অসুস্থ বাবা-মা, শিশু, বোন, ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক মানবিক, শিল্প-সাংস্কৃতিক, সামাজিক কল্যাণমূলক কাজও ফেসবুকের মাধ্যমে সাধন হচ্ছে।

কিন্তু কেবলমাত্র যাচ্ছেতাই(যা ইচ্ছে তাই)ভাবে ব্যবহারের প্রভাবে আমরা কি হারিয়ে ফেলছি না আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-আবেগ-অনুভূতি? মানবিকতার জন্য ঘরে বসে চিৎকার করতে করতে আমরা কি ভুলে যাচ্ছি না মানবিকতার চর্চা?

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭