ইনসাইড থট

মরনেও বিভ্রান্তি ঘুচল না এরশাদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/07/2019


Thumbnail

সকাল পৌনে আটটায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর জানাজা-দাফনের কর্মসূচীর সাথে জানা গেলো সাবেক সেনাপ্রধানকে দাফন করা হবে বনানীর সামরিক গোরস্থানে। কিন্তু একটু পরেই প্রশ্ন কোথায় দাফন হবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার? সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) এইচ এম এরশাদ দেশের এক আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিকের নাম। যিনি কৌশল আর কূটকৌশলে নিজের স্থান করে নিয়েছেন দেশের রাজনৈতিক ইতিহসে। আজ সব ভুলে গিয়ে কেউ কেউ তাকে ‘‘মেধাবী সফল রাজনীতিক’’ হিসেবে অভিহিত করতেও পিছপা হচ্ছেন না। সময় এক বড় নিয়ামক । ভাগ্যের বরপুত্র এইচ এম এরশাদ ৬০/৭০ বা ৮০ বছর বয়সে মারা গেলে কি তার মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া আজকের মত হতো?

এরশাদের মৃত্যুর পর পরই সিএমএইচেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা জানাজাসহ বিস্তারিত কর্মসূচী গনমাধ্যমে জানানোর সময়ই বলেছিলেন যে দাফন হবে বনানীর সামরিক কবরস্থানে। কিন্তু পরে যখন তিনি বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারপারসনের অফিসে আসেন, তখন নেতা-কর্মীদের ঘেরাওয়ের মুখে জানান যে নেতা-কর্মীরা চাইলে দাফনের স্থান পরিবর্তন হতে পারে। ওদিকে রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা তাদের ‘‘ছাওয়াল’’কে রংপুরেই সমাহিত করতে চান।বেচে থাকতে এরশাদ নিজে তার কথার বা সিদ্ধান্তের বারবার পরিবর্তন করতেন।এমনকি নিজে তা স্বীকারও করে গেছেন।  নিজের দেওয়া ‘‘পল্লীবন্ধু’’ উপাধি তাই তার জীবদ্দশাতেই ‘‘পল্টিবন্ধু’’ হিসেবে বদলে গিয়েছিল।

আর যে বললাম ৩০ বছর আগে যদি এইচ  ৬০ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ হিসেবে মারা যেতেন তাহলে সারাদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে কান্নকাটি চলতো। আর আন্দোলনে সক্রিয় বিরোধী রাজনীতিকরা রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতেন মাত্র। যদি ২০০৯ সালে এইচ এম এরশাদ ৮০ বছর বয়সে মারা যেতেন তাহলে তিনি সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার সম্মান পেতেন না। এমনকি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর ‘‘বিশেষ দূত’’ বা সংসদের আনুষ্ঠানিক বিরোধীদল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সম্মান জুটতো না।কিন্তু তিনি হয়তো একারনেই ৯০ বছর পর্যন্ত বেচে ছিলেন, যেন ১৯৮৬ সালের সংসদ ভেঙ্গে দেয়া বা ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন সংসদ প্রতিষ্ঠার নায়ক এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হতে পারেন মৃত্যুর ছয়মাস আগে। তার আগে ২০১৪ সালে নিজের স্ত্রী আর সাবেক ফার্স্টলেডীকে বানাতে পেরেছিলেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। যখন মারা গেলেন তখন নিজে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা আর স্ত্রী বিরোধীদলীয় উপনেতা। আর তা করেছিলেন আপনভাই জি এম কাদেরকে সরিয়ে। সেই জি এম কাদেরকেই দিয়ে গেলেন নিজের প্রতিষ্ঠিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি তৈরী করে আনুষ্ঠানিক রাজনীতি শুরু করার পর প্রায় দুযুগে নিজেকে তিনি পরিণত করেছিলেন ক্ষমতার গুরুত্বপুর্ণ নিয়ামকে। আর সেকারণেই ২০০৫ সালে যেমন পল্টন ময়দানের জনসভায় বসেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে, আবার তেমনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়ে নিজের বিরুদ্ধের মামলাগুলোকে শ্লথ করে দিয়ে সংসদে বসেছিলেন বিরোধীদলের নেতার আসনে। আর তার মুখোমুখি  প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। অথচ শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া রাজপথের আন্দোলনে পরাজিত করে এইচ এম এরশাদকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছিলেন। জনরোষে পতন হওয়া স্বৈরশাসকের ঠাই হয়েছিল কারাগারে। যদিও কারাগারে থেকে পরপর দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১ ও ১৯৯৬) পাঁচটি করে আসনে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার বিরল কৃতিত্বও আছে রাজনীতিক এরশাদের সাফল্যের ঝুড়িতে। কিন্তু এটাও ঠিক যে এইচ এম এরশাদই হতে গোনা কয়েকজন রাজনীতিকের একজন , যিনি দুর্নীতি মামলায় সাজা পাওয়ার সাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী নির্বাচনে অযোগ্য হয়েছিলেন ২০০১ সালে। আবার তিনি ক্ষমতার সহযোগী হয়ে একজন হত্যা মামলার আসামী হিসেবে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলার রায়কেও ঠেকিয়ে দিতে পেরেছেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশে সামরিক শাসন জারী করেছিলেন এইচ এম এরশাদ। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দেশে যে সামরিক শাসন ছিলেন তার বড় ভুক্তভোগী ছিল তখনকার ছাত্রসমাজ। ২০০২ সালে বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে এইচ এম এরশাদের সাথে আলাপে তিনি বলেছিলেন ‘‘তোমরা ভুল বুঝেছ, আমি সেনাপ্রধান ছিলাম। রাজনৈতিক কারনে সেনাপ্রধান হিসেবে সামরিক আইন জারী করা তখন আামার দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল।’’ সেদিনই তাকে বলেছিলাম ছাত্রঅবস্থায় আপনার কারনে ছাত্ররাজনীতি করতে হয়েছে পুলিশী নির্যাতনের মধ্যে, বাড়ী ছাড়া হতে হয়েছে অসংখ্যবার। সহযোদ্ধা রাউফুন বসুনিয়াকে হারিয়েছি। শহীদ নূর হোসেনসহ অসংখ্য শহীদের মৃত্যুর জন্য আপনাকেই দায়ী করি আমরা। গাইবান্ধায় প্রিয়বন্ধুরা সামরিক আদালতে দন্ডিত হয়েছিল। আমার ক্ষোভ শুনে এইচ এম এরশাদ স্মিত হেসে বলেছিলেন ‘‘রাজনীতি করার জন্যতো আমাকেও ছয়বছর জেল খাটতে হয়েছে।’’ ইসলামকে রাষ্ট্রর্ধম করার সমালোচনা শুনেও ক্ষুদ্ধ না হয়ে জানিয়েছিলেন যে তিনিই জন্মাষ্টমীর দিনকে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন ‘‘হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টও আমার করা ,তারপরও হিন্দুরা আমার সমালোচনা করে।’’

এটা সত্য যে আজ অনেকেই এরশাদের নানান গুনের কথা সামনে আনবেন। অবশ্যই প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে নিজেকে জাতীয় রাজনীতিতে শুধু টিকে থাকা নয় , হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার করে , কৌশলে নিজেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় করে তোলার এক অনন্য গুনের অধিকারী এইচ এম এরশাদ। দেশে প্রথম আন্ত:নগন ট্রেন চালু এবং সেসব ট্রেনের কাব্যিক নামে দিয়ে ,টিকিট কাটলে আসন সুনির্দিষ্ট থাকবে , দেশের মানুষকে তেমন সম্মাণিত যাত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানই। এখনকার বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরীর জন্য, এমনকি সিনেমার টিকিটেও যমুনা সেতু সারচার্জ আরোপের কৃতিত্ব নিতে পারেন এরশাদই। সোডিয়াম লাইটের ধূষর আলোতে মানুষের রঙ বদলানোর ‘‘সফল রাজনীতিক’’ তার সম্পর্কে দেশবাসীর মনোভাবও বদলে দিতে পেরেছিলেন, হয়তো সেজন্যই তার আয়ুষ্কাল নির্ধারিত ছিল ৯০ বছর , আর শেষ দুসপ্তাহ ছাড়া পুরোটা জীবন তিনি সক্রিয় ছিলেন। উপভোগ করেছেন নিজের জীবনও। কবিতা গান ‘‘লিখে’’ প্রেম করে, সুপুরুষ এরশাদ এখন এক ‘‘বর্নাঢ্য রাজনীতিকের’’ স্বীকৃতি আদায় করেই প্রয়াত হলেন। আজ হয়তো সংবাদ মাধ্যমগুলো কেউ শিরোনাম করবে না ‘‘ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিদায়’’। কারন নিজের বুদ্ধি আর কৌশলে সফল এইচ এম এরশাদ এখন শুধুই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান,সাবেক রাষ্ট্রপতি আর জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। এমনকি সাবেক সেনাপ্রধানের প্রথম জানাজাও হলো ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় মসজিদে।

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭