লিভিং ইনসাইড

‘সাবধান! বুঝেশুনে ছুরি চালান’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 10/08/2019


Thumbnail

ঈদ-পার্বণের অন্যতম অনুসঙ্গ বাড়তি রান্না আর অতিথি আপ্যায়ন। তাই স্বাভাবিকভাবেই রান্নাঘরের কাজের চাপটা বেড়ে যায়। বাঙালি সমাজে রান্নাঘরটা মোটামুটি গৃহিণীরাই সামাল দেন। তবে ঈদ-পার্বণে মা, স্ত্রী বা আপনজনের সাহায্যে এগিয়ে আসেন অনেকেই। সালাদ কাটা, ফল কাটা, আদা রসুন পেয়াজ কাটা এসবের মাঝে উৎসবের আমেজ খুঁজে পান একশ্রেণীর মানুষ। আবার ঈদ এলে বিশেষত কোরবানী ঈদে একধাপ এগিয়ে গোশত কাটতেও দ্বিধা করেন না উৎসবপ্রিয় বাঙালিরা। অতীতে এই কাটাকাটি দা ও বটিনির্ভর হলেও যুগের পরিবর্তনে রান্নাঘরে ঠাঁই করে নিয়েছে অনেক রকম ছুরি। তবে সাবধানতা অবলম্বন না করলে এই ছুরি চালাতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনা এমনকি মারাত্নক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষত বছরের একটি মাত্র দিনে নিজ হাতে মাংস কেটে এবং অন্যদের বিলিয়ে যারা ধর্মীয়ভাবে তৃপ্ত হতে চান তাদের ক্ষেত্রে এই সতর্কতা বেশি প্রয়োজন। আবার একটি ছুরি দিয়ে যারা ঘরের সব কাজ করতে চান, তাদের জীবনেও বিপদ হানা দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জরুরি বিভাগের তথ্যমতে প্রতি দুইহাজার আমেরিকানের মধ্যে দৈনিক তিনজনেরও বেশি রান্নাঘরের ছুরি ব্যবহারের সময়ে দুর্ঘটনা ঘটান। জরুরি বিভাগে ছুরি ব্যবহারজনিত চিকিৎসায় আগতদের মধ্যে ৯৪% ই গভীরভাবে (Deep cut) আঙুলে কাটা নিয়ে আসেন। ছোট ছুরিতে ৪৭%, রান্নাঘরের বড় ছুরিতে ৩৬% এবং অন্যান্য ধরনের ছুরিতে ১৭% দুর্ঘটনা ঘটে। (সূত্র: জার্নাল অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন ৪৫(৪) জুলাই, ২০১৩)

অন্যদিকে বাণিজ্যিক সংস্থা ফিঙ্গার কাট কিট মতে ঘরের কাজে দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটে আঙুল দিয়ে। প্রতিবছর প্রায় ২ কোটি মানুষ ছুরি নিয়ে কাজ করার সময়ে আঙুল কাটে এবং রক্ত বন্ধ করতে না পারলে চিকিৎসকের কাছে যায়। সুতরাং ছুরি দিয়ে কাটাকাটির সময় সাবধানতার বিকল্প নেই।

সব ছুরি সব কাজের জন্য নয়

বাঙালি সমাজে ছুরির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে সেই ছোটবেলাতে। বিশেষত গ্রামে কাচা আমের মৌসুমে একটা ছুরি কিনতে পারা ছিল পরম পাওয়া। আগে ছোট ছোট ছুরি পাওয়া যেত যেগুলো ভাঁজ করে পকেটে রাখা যেত। পরে নানা আকৃতির ছুরিতে বাজার ছেয়ে যায়। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সুদূর প্রাচীনকালে মানুষ জীবনরক্ষা , ফসল কাটা, পশুহত্যা, মাছ শিকার এবং যুদ্ধের জন্য ছুরি ব্যবহার করত। পরে খেলাধুলায় ছুরি নিক্ষেপ সংযোজিত হয়। শিল্পবিকাশের সঙ্গে ছুরি একটি টুল বা মেরামত সামগ্রী হিসেবে সমাদৃত হয়। জাতিগত ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে ছুরির দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সালতানাত অব ওমানের জাতীয় নিদর্শনে রয়েছে একজোড়া ছুরি। শিখ ধর্মের ৫টি স্তম্ভের একটি হলো ‘কিরপান’ নামের এক ধরনের ছুরি। নেপালের ঐতিহ্যে ‘কুকরি’ নামের ছুরির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ছুরি নিয়ে গল্প, উপন্যাস, প্রবাদ, কুসংস্কার , ধর্মীয় উন্মাদনার কমতি নেই। তবে সবকিছুকে পেছনে ফেলে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে রান্নাঘরে ব্যবহৃত নানারকম ছুরি, যা কিচেন নাইফ হিসেবে সমাদৃত। উইকিপিডিয়াতে শুধু রান্নাঘরে ব্যবহৃত হয় এমন ১৩ ধরনের ছুরির বর্ণনা রয়েছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কাজের জন্য প্রায় ২০ ধরনের কিচেন নাইফ বাজারজাত করে। যেমন- মাংস কাটা, মাছ কাটা, কেক/ব্রেড কাটা, চিজ কাটা, ফলের খোসা ছাড়ানো, সালাদ ও ফুল বাগান প্রভৃতির জন্য বিশেষ বিশেষ ছুরি। তবে মনে রাখা দরকার, সব ছুরি কাজের জন্য নয়। তাই জানা দরকার কোন কাজে কোন ছুরি ব্যবহার করতে হবে।

ছুরিজনিত দুর্ঘটনার মূল কারণ

১. কাজ করার সময় বিপরীত দিকে থেকে নিজের দিকে ছুরি চালানো বা টেনে আনা।

২. ধারবিহীন বা কম ধারের ছুরি ব্যবহার করা।

৩. ছুরির শক্তি বা সাধ্যের বাইরে কোনোকিছু কাটার প্রচেষ্টা।

৪. ছুরি সংরক্ষণ বা তুলে রাখার ক্ষেত্রে অসতর্কতা।

৫. উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাওয়ার সময় ছুরি ক্যাচ ধরার চেষ্টা।

৬. ছুরি নিয়ে কাজ করার সময় অমনোযোগী হওয়া। বিশেষত মোবাইল, টিভি ইত্যাদির পর্দায় চোখ রাখা।

৭. একই ছুরি দিয়ে সব ধরনের কাজ করার চেষ্টা।

৮. ছুরির উপযুক্ততা বা দক্ষতার বদলে শারীরিক শক্তি দিয়ে কোনোকিছু কাটার চেষ্টা।

৯. পানিতে ডুবানো, ড্রয়ারে রাখা বা ব্যাগে অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে বহনকৃত ছুরি বের করার সময় অসতর্কতা বা অজ্ঞতা।

১০. ছুরি নিয়ে অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো।

ছুরি নিয়ে যা করবেন না

১. কখনো আঙুল দিয়ে ছুরির ধার পরীক্ষা করবেন না।

২. ছুরি উঁচুস্থানের যেমন টেবিল, র‌্যাক, সিংক ইত্যাদির কিনারায় রাখবেন না।

৩. জমানো পানিতে যেমন পানিভর্তি সিংক, বালতি, ডেকচি ইত্যাদিতে ছুরি ডুবিয়ে রাখবেন না।

৪. উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়ার সময় ছুরি ধরতে যাবেন না। বরং পা সরিয়ে নিন এবং অন্যদের সতর্ক করুন।

৫. অন্যের হাতে সরাসরি ছুরি দেবেন না বা নেবেন না। প্রয়োজনে মাটিতে বা মাঝখানের নিরাপদ স্থানে ছুরি রেখে বিনিময় করুন।

৬. কাটাকাটির সময়ে অন্য কোনোদিকে বিশেষত মোবাইল ফোনের দিকে হাত দেবেন না।

৭. ড্রয়ারে ছুরি বা ধারালো কিছু রাখবেন না।

৮. তরকারি বা ফলের খোজা ছাড়াতে ছুরির বদলে পিলার ব্যবহার করুন, যেনতেন ছুরি ব্যবহার করবেন না।

৯. সব ধরনের ছুরি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে ভুলবেন না।

১০. হাতলের সঙ্গে ছুরির সংযুক্তি শক্ত বা দৃঢ় না থাকলে ছুরি ব্যবহার করবেন না।

১১. তেল, চর্বি, সাবান বা পিচ্ছিল কোনোকিছু হাতলে লাগা থাকলে তার পরিস্কার না করে ব্যবহার করবেন না।

১২. প্রয়োজন ছাড়া ছুরি বের করবেন না বা স্পর্শ করবেন না।

১৩. উত্তেজিত অবস্থায় ছুরি ধরবেন না।

ছুরি ব্যবহারে করণীয়

১. নির্দিষ্ট কাজের জন্য উপযুক্ত ছুরি ব্যবহার করবেন। মনে রাখবেন সব ছুরি সব কাজের জন্য উপযুক্ত নয়।

২. কাটিং বোর্ড যাতে সরে না যায় অথবা স্লিপ না করে সেজন্য বোর্ডের নিচে একটি ভারি কাপড় রাখুন।

৩. ছুরি দিয়ে কাজ করার সময়ে অন্য কাজের প্রয়োজন হলে ছুরিটিকে সবার আগে নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন।

৪. একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার সময় ছুরিটিকে শরীর থেকে দূরে রাখুন এবং ধারালো দিক একটু বাঁকা করে রাখুন।

৫. প্রয়োজন শেষে ছুরি শুকিয়ে নাইফ হোল্ডার বা বক্সে সংরক্ষণ করুন।

৬. ধারালো সবকিছু ব্যবহারের সঠিক নিয়ম জেনে নিন।

৭. যেকোনো কিছু কাটার সময় বিশেষত আপেল, আনারস, গোল বেগুন, গোল আলু ইত্যাদি কাটার সময়ে ফল বা তরিতরকারি প্রথমেই সমান দুইভাগ করে কাটুন।

৮. দৃঢ় বা শক্ত করে ছুরি ধরুন। আলতো করে ছুরি ধরলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

৯. ধারালো ছুরি ব্যবহার করুন। ধার কম থাকলে বেশি জোর বা প্রেসার দিতে হয়। এতে দুর্ঘটনা বাড়তে পারে।

১০. সবসময় কাটিং বোর্ডের ওপর কাটাকাটি করুন। সমান কোনোকিছু যেমন- প্লেট, সিংক বা কাঁচের টেবিলে রেখে কাটাকাটি করতে দুর্বল লাগে।

১১. হাত ও আঙুলের সুরক্ষায় বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা গ্লাভস ব্যবহার করুন।

১২. অন্যান্য তৈজসপত্র থেকে আলাদা করে ছুরি পরিস্কার করুন।

১৩. চোখা বা তীক্ষ্ম আগাযুক্ত ছুরির বদলে যথাসম্ভব গোল আগার ছুরি ব্যবহার করা।

সবার ঈদ হোক আনন্দময় ও নিরাপদ। ঈদ মোবারক।

লেখক: কলামিস্ট ও লেখক। সেনাবাহিনী ও কর্পোরেট জগতে চাকরি করেছেন দীর্ঘদিন। বিদেশে স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন এক দশক।

ফোন নম্বর- ০১৭১১৯০৮৪২০

 

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭