ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর প্রথম তদন্তের গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 13/08/2019


Thumbnail

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা পরবর্তী তদন্তপ্রক্রিয়া আর মামলা নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। আত্মস্বীকৃত খুনীদের তদন্ত আর বিচার প্রলম্বিত হয়েছে অনেক। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালে, যুক্তরাজ্যে। দেশের মাটিতে আইন করে বিচারের পথ এগোয়নি। তাই তৎকালীন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রাইডসহ চার ব্রিটিশ আইনবিদ মিলে এ তদন্ত কমিশন গড়ে তুলেছিলেন। তবে অনুসন্ধানের কাজে এ কমিশনকে বাংলাদেশে ভিসা দেয়নি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার।

আইনজ্ঞ আর তদন্তের কাজে নিয়োজিত বাঙালীরা জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত প্রথম কমিশন এটি। এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরতে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্ট। এ কমিশনকে দেশে আসতে না দেওয়ায় বোঝা গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের প্রতি সামরিক সরকারের সরাসরি সমর্থন ছিল, তারাই তদন্তে বাধা দিচ্ছিলো।

ওই অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদনটি ছিল শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি: প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি শিরোনামে। এটি পুস্তিকা আকারে লন্ডনের র‍্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘বার বার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সরকার একজন হত্যাকারীকেও বিচারের মুখোমুখি করেনি। বস্তুত এসব হত্যাকারী এবং তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা এবং সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। এদের কাউকে কাউকে বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যরা দেশেই নানা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এভাবে অপরাধকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।’

প্রকাশিত পুস্তিকায় এ কমিটি গঠনের শুরু থেকে অনুসন্ধান কমিশনের সিদ্ধান্তগুলোর উল্লেখ ছিল। এ কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের একটি কমিটির কক্ষে। ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে কমিশনে আরও ছিলেন আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী আইনবিদ অবরি রোজ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে কমিশনের কাছে আবেদন করেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, জাতীয় চার নেতার অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর ছেলে প্রয়াত মোহাম্মদ সেলিম এবং আরেক জাতীয় নেতা এবং সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে বাধা আসে। হত্যার পরপরই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। তবে ২০০০ সালে হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন এবং পরের বছর হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে অন্য তিনজনকে খালাস দেন। কিন্তু পরবর্তী ছয় বছর মামলার শুনানি না হওয়ায় ওই রায় কার্যকর হয়নি।

শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি: প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি পুস্তিকাটিতে যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধান কমিশনের প্রথম বৈঠকের পর দেওয়া বিবৃতিটি সংযুক্ত আছে। কমিশনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং জাতীয় চারনেতা হত্যার ঘটনার আইন ও বিচারের প্রক্রিয়া কেন সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তা অনুসন্ধান করা। কমিশন এজন্য দেশে-বিদেশে প্রকাশিত নানা বিবৃতি-বক্তব্য, নথিসহ প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে।

১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি কমিশনের সদস্য স্যার জেফরি টমাসের মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানের জন্য একজনকে নিয়ে ঢাকায় আসবে বলে কমিশনের সদস্যসচিব অবরি রোজ তাঁদের দুজনের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেছিলেন। তাদের দুজনের ১৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সন্ধ্যার ফ্লাইটে টিকিট কাটা ছিল, তাই ভিসার জন্য সকালে হাইকমিশনে জানানো হয়। বাংলাদেশ হাইকমিশন জানায়, তাঁদের পাসপোর্ট, ভিসা বিকেলের মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে। বিকেলে হাইকমিশন থেকে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট শাখা বন্ধ হয়ে গেছে। পরে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে অনুসন্ধান কমিশনকে জানানো হয় ঢাকায় যাওয়ার ভিসা দেওয়া হবে না জেফরি টমাস ও তার সহযোগীকে।

১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশে পাঠানো কমিশনের প্রতিবেদনেও দৃষ্টি দেয় অনুসন্ধান কমিশন। এপ্রিলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মিশনের নেতৃত্ব দেন কমিশনের সদস্য শন ম্যাকব্রাইড। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি মূলত জেলহত্যা নিয়ে কথা বলেন। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ওই কমিশনকে জেলহত্যার আইনানুগ বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধান কমিশন সার্বিক বিবেচনার পর তিনটি সিদ্ধান্তে আসে-

১. এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে আইন ও বিচারপ্রক্রিয়াকে যথাযথভাবে এগোতে দেওয়া হয়নি।

২. বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে সরকারই দায়ী।

৩. হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রক্রিয়ার বাধাগুলো দূর করতে হবে এবং সেই সঙ্গে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে তার নিজ ধারায় অগ্রসর হতে দিতে হবে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে এ ধরনের কমিশন গঠনের বিষয়টি স্বীকৃত। এ ধরনের কমিশনকে দেশে আসতে না দেওয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় উঠে আসে। অনেক সময় অপরাধের বিচার চলমান থাকলে বিচারকাজে বিঘ্ন হওয়ার শঙ্কায় সরকার এমন কমিশনকে নাও আসতে দিতে পারে। আবার অপরাধ যেন সবার সামনে না আসে এবং বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে সরকার এমন কমিশনের কাজে বাধা দেয়। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের ধারণা, বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় গঠিত এই কমিশনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টি ঘটেছে। জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে এতে।

কমিশন তিনটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ এবং তা পর্যালোচনা করে। সেগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং জাতীয় চার নেতার হত্যাসংক্রান্ত কাগজপত্র; জনসমক্ষে এসব হত্যার দায় স্বীকার করে যেসব ব্যক্তি বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাঁদের সংক্রান্ত এবং এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের গ্রহণ করা পদক্ষেপগুলো। মোট ২০ অনুচ্ছেদে এ প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য তুলে ধরা হয়।

লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমকে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ফারুক ও রশিদ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্যাংককের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যান।

ব্যাংককে থাকাকালীন কর্নেল ফারুক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের সানডে টাইমসে এবং ওই বছরের ২ আগস্ট লন্ডনে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন ফারুক।

বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার ঘটনা অনুসন্ধানের পর এই কমিশন ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে শনাক্ত করে। তাঁদের নানাভাবে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দেয় ১৯৭৫ পরবর্তী সরকার।

জেলহত্যার বিষয়ে সরকার বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর, লালবাগ থানায় মামলাও হয়। বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই কমিশনের আরও সদস্য ছিলেন বিচারপতি কে এম সোবহান এবং বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন। পরে মামলাটি অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ছয়বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচারপ্রক্রিয়া। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে হাইকোর্টের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে ১২ খুনির ।

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭