ইনসাইড আর্টিকেল

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: বিদেশী ষড়যন্ত্রের তদন্ত হবে কবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/08/2019


Thumbnail

জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির স্বপ্নের মৃত্যু, একটি স্বাধীন দেশকে পরাধীন করে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র।

১৫ আগস্ট নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে সংঘটিত কোন ঘটনা নয়। দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের ফলাফল ছিল এই বর্বরোচিত ঘটনা। গুটিকয় সামরিক অফিসার মিলে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল এটা ভাবা ভুল হবে। এই ভয়ংকর ঘটনায় দেশীয় স্বার্থান্বেষীদের পাশাপাশি জড়িত ছিল বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরাও। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, চীন, সৌদি আরব এবং দেশীয় সুবিধাভোগী, পাকিস্তানপন্থী ও আওয়ামীলীগ বিরোধীদের সম্মিলিত একটি ষড়যন্ত্রের উপাখ্যান। দেশি-বিদেশি যে আন্তর্জাতিক চক্র একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, পঁচাত্তরে তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে। একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের কিসিঞ্জার, পাকিস্তানের ভুট্টো ও বাংলাদেশের মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের ঠাকুর আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। পঁচাত্তরে সেই কিসিঞ্জার-ভুট্টো চক্রের ষড়যন্ত্রে শেখ মুজিবের লাশ ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে রেখেই মোশতাক সেনাবাহিনীর পাকিস্তানের চরদের মদদে রাষ্ট্রপতির গদি দখল করে। সিআইএর চিহ্নিত এজেন্ট মাহবুবুল আলম চাষী ১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন আর মোশতাক ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন-কিসিঞ্জার এবং পাকিস্তানের ভুট্টো চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতারই শুধু বিরোধিতা করেনি, স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে বিশ্ব মানচিত্রে টিকে থাকতে না পারে তারও চক্রান্ত করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রবল প্রতাপশালী দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের প্রতি কিসিঞ্জারের ঘৃণার কথা স্বীকার করেছেন। মরিস জানান, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কিসিঞ্জার তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন আলন্দে, থিউ ও মুজিব। এ তিনজন কিসিঞ্জারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পাকিস্তানকে পরাজিত করে এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের জন্য অত্যন্ত বির্বতকর।’

বিদেশিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের ভুট্টো। অবশ্য ভুট্টোর পরিণতি ছিল আরও মর্মান্তিক। জে. জিয়াউল হক ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালে ফাঁসি দেয়ার আগেই ফাঁসির সেলে সীমাহীন নির্যাতন করে। বেনজীর ভুট্টো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফাঁসির পূর্বে তিনি তার বাবাকে দেখতে গিয়েছিলেন। নির্যাতনের ফলে ভুট্টো এমন নির্জীব হয়ে পড়ে যে তার এক গ্লাস পানি উঠিয়ে খাওয়ার ক্ষমতা ছিল না।

১৫ আগস্ট মুজিব হত্যার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তান বাংলাদেশের খুনি সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় খুশিতে ডগমগ ভুট্টো তাৎক্ষণিকভাবে মীরজাফর মোশতাক সরকারকে দুই কোটি ডলার মূল্যের ৫০ হাজার টন চাল ও দেড় কোটি গজ কাপড় দেয়ার কথা ঘোষণা করে। বিদেশি প্রভুদের মদদে খন্দকার মোশতাক ও সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জে. জিয়াউর রহমানের লেলিয়ে দেয়া ফারুক-রশিদ-ডালিম-নূর চক্র বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং তার স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের আগের ও পরের রাজনৈতিক ঘটনা ও ইতিহাসের চিত্র তখন বিশ্ব গণমাধ্যমে যেভাবে উঠে আসছিল তার ওপর বেশ কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাবও ছিল। ঘটনার পরদিন, ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট তার নয়াদিল্লি প্রতিনিধির লেখা প্রতিবেদন ছাপালো। সেখানে লেখা ছিল, ‘একটি সেনা সমর্থিত সরকার মধ্যরাতে পরিচালিত এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছে। মনে করা হচ্ছে সরকারটি ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষের।’

ওয়াশিংটন পোস্টের ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে বামপন্থি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তুলে ধরা হয়। সরাসরিই লেখা হয়, ‘ক্ষমতাচ্যুতির ওই বিদ্রোহ প্রায় স্বৈর-ক্ষমতার পর্যায়ে চলে যাওয়া এবং দারিদ্রপীড়িত দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের জনক বামপন্থি রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্টের আসনে বসা খন্দকার মোশতাক আহমেদ সেনা বিদ্রোহের ১৮ ঘণ্টা পর সম্প্রচার করা এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, মুজিবই বাংলাদেশের দারিদ্র্যের জন্য দায়ী। ‘তার শাসনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং এক হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা ছিল’ মোশতাকের এ উক্তি ওয়াশিংটন পোস্ট ছাপিয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনে মন্তব্য হিসেবে পত্রিকাটি বলেছিল, বঙ্গবন্ধুর এ মৃত্যু তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির প্রতি একটা ব্যক্তিগত আঘাতও বটে, যিনি প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রবিষয়ক নীতিমালায় সমর্থন দিতেন।

বঙ্গবন্ধু মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বিদ্রোহ নিয়ে বিস্তারিত লিখলেও তৎকালীন সোভিয়েত পত্রিকা ইজভেস্তিয়া ভেতরের পাতায় এ ঘটনার একটা ছোটখাটো খবর ছেপেছিল। সেখানে কারও উক্তিও ছিল না। তবে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রিকা প্রাভদা লিখেছিল, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার ‘প্রতিকূল শক্তিরা’ হয়তো দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকান্ডের ঠিক এক সপ্তাহ পর নিউইয়র্ক টাইমস মস্কো থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘গত সপ্তাহে বাংলাদেশে হওয়া সেনা বিদ্রোহের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ক্রেমলিন আজ (২২ আগস্ট) ইঙ্গিত দিয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাত হয়তো দেশটিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দূরে সরিয়ে চীনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫-এ ঢাকার ডেটলাইন দিয়ে ভারতীয় পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার এক সপ্তাহ পর চীনও তার স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাও বলা হয়, ভারতও মোশতাক সরকারের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে সানডে টাইমসের অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লন্ডনের আইটিভির ‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’ অনুষ্ঠানের জন্য বঙ্গবন্ধুর দুই স্বঘোষিত হত্যাকারী লে. কর্নেল ফারুক ও লে. কর্নেল রশিদের সাক্ষাৎকার নেন। দুই আগস্ট প্রচারিত ওই অনুষ্ঠানে হত্যাকারীরা বর্ণনা করেন কীভাবে তারা ১৯৭৫-এর ২০ মার্চ তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, কীভাবে দেশের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার পরিকল্পনার কথা তাকে বলেছিলেন। সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ ও মার্টিন উলাকট ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্ণনা ছিল সবচেয়ে বিস্তারিত বর্ণনার একটি। ওই দিন কী হয়েছিল এবং তার পেছনে কী কী কাজ করেছে তার অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছিল তাদের লেখনিতে। ওই প্রতিবেদন ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান ২৮ আগস্ট, ১৯৭৫ তাদের লিড নিউজ হিসেবে প্রকাশ করেছিল।

বঙ্গবন্ধু-১৫ আগস্টের চার বছর পর ১৯৭৯-র ১৫ আগস্ট লিফশুলজ শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাতের সে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনের চক্রান্ত নিয়ে আরেকটি লেখা লিখেন। সেটাও গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটিতে লিফশুলজ লিখেছিলেন, ‘ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে কর্মরত মার্কিন কর্মকর্তা এবং বিস্তারিত জানা বাঙালি কিছু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য ঘটানো সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানত। এমনকি মার্কিন দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের ছয় মাসেরও বেশি সময় আগে বিদ্রোহ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসেছেন।’ ‘বিভিন্ন প্রতিবেদনে কোন বিদেশি বা বাঙালি সাংবাদিকই ভাসাভাসা কথাগুলোর গভীরে গিয়ে কিছু জানার চেষ্টা করেননি। সেনা কর্মকর্তারা একাই ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন কোন রাজনৈতিক পরিকল্পনা ছাড়াই এ ব্যাখ্যার সংস্করণটি একটি মিথ, যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল,’ লিখেছিলেন লিভশুলজ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ভারতের ভূমিকাও কিছুটা রহস্যাবৃত। বলা হয় যে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হতে পারে বলে সতর্ক করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা গ্রাহ্য করেননি। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, ভারতের গোয়েন্দারা বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে তার সমস্ত খবরাখবরই রাখতেন। কোনো কিছুই তাদের অগোচরে ঘটতো না। এতো বড় একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেটার তথ্য তাদের না থাকাটা অস্বাভাবিক। কিন্তু ভারত কি সেই তথ্যগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিল? নাকি দায়সারাভাবে শুধু হত্যার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিল তারা, যেটা বঙ্গবন্ধুর কাছে খুব একটা জোরালো মনে হয়নি?

জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের পর ৪৪ বছর কেটে গেছে। এখনও এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর জানতে পারেনি বাঙালি। এজন্যই এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হয়েছিল তার তদন্তের দাবি উঠছে। কারণ একটি হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের বিচার যতটা জরুরী, তার থেকেও বেশি জরুরী নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয় উন্মোচন করা।  

বাংলা ইনসাইডার/এএইচসি



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭