ইনসাইড থট

প্রধানমন্ত্রীর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ কোরবানির চামড়া!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 14/08/2019


Thumbnail

গরীব শোষণের মাধ্যমে পুঁজি গঠন এখন বড়লোকদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাঁরা সমাজের ওপিনিয়ন মেকার নন, আর সমাজের ওপিনিয়ন মেকারগন তাঁদের পক্ষে কখনোই জোরালো কথা বলেন না। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ী সিণ্ডিকেটের তুঘলকি কাণ্ডের চরম রূপ প্রকাশিত হল এবছর। তাই অবশেষে মানিনীয় প্রধানমন্ত্রী কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছেন। এটা চামড়া ব্যবসায়ী সিণ্ডিকেটের জন্য একটা চরম খারাপ খবর বটে। আরেকটি খারাপ খবর তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে যা অনেকেই জানেন না। জানেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কিছু কর্মকর্তা। চামড়া ব্যবসায়ী সিণ্ডিকেটের জন্য সেটা যেমন দুঃসংবাদ সেটি দেশের কোটি কোটি গরীব মেহনতি মানুষের জন্য স্বস্তির আর প্রশান্তির খবর হতে যাচ্ছে। সুখবর দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ আর সন্তানের সুস্বাস্থ্য কামনাকারী বাবা-মায়েদের জন্য।

বিভিন্ন পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে যে, নগণ্য দামে অর্থাৎ ৫০/৬০ টাকা দরে চামড়া বিক্রি না করে সৈয়দপুরে কোরবানির পশুর আট শতাধিক চামড়া মাটির নীচে পুতে ফেলা হয়েছে৷ ঢাকা মহানগরীর প্রান্ত ঘেঁষে বহু এলাকায় পশুর (গরুর) চামড়া ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। অন্য বছরের মত মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী অনেক এলাকাতেই দেখা যায় নি। কারণ এবার চামড়া ব্যবসায়ীগণ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার মূলধন দেন নি। সেকারণে নিজের টাকায় চামড়া কিনে গত বছর বা তার আগের বছরের মত পুঁজি হারানোর ঝুঁকি বেশিরভাগ মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী নেন নি। এবার এসব ঢাকায় মহল্লা ভিত্তিক ক্রেতা ছিলেন মূলত: বিভিন্ন মাদ্রাসার হুজুর আর ছাত্র। তাঁদের দুটি লাভ। কেনার সময় লিল্লাহ বোর্ডিঙের দোহাই দিয়ে কম দামে কিনতে পারে। আর চামড়া ব্যবসায়ীগণও এদের কাছ থেকে কম দামে কিছু বাকীতে কিনতে পারেন, কারণ মাদ্রাসার লস বলে কিছু নেই।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে চান বলে মনে হচ্ছে। গুলশানের হলী আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের আগেই জাইকা একটা প্রাথমিক জরিপ চালায়। কারণ তাঁরা ঢাকা মহানগরীর আবর্জনা ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছে। যদিও উদ্যোগটি গুলশানের হলী আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের পরে থেমে যায়। যা আবার শুরু হতে যাচ্ছে বলে স্থানীয় সরকারের একটি সূত্র আভাস দিয়েছেন।

বর্তমান সরকার প্রাথমিকভাবে মহানগরী ঢাকা সহ বড় বড় নগর আর শহরে অত্যাধুনিক কসাইখানা বা স্লটার হাউজ বানাবে জাইকা বা কোন দাতা সংস্থার ঋণের টাকায়। যা হতে পারে পিপিপি’র আদলে। মহানগরী ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক স্লটার হাউজ বানানো হবে পিপিপি’র মাধ্যমে। যেখানে ঋণ পরিশোধের জামিনদার হিসেবে জমি দেবে সরকার আর চামড়া রপ্তানিকারক বা চামড়া ব্যবসায়ী আর কিছু রপ্তানিকারক এই স্লটার হাউজ নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পাবেন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমানত রেখে। সরকারের পক্ষে থেকে সেখানে ডাক্তার থাকবেন যারা নিয়মিত পশু, হাস-মুরগী পরীক্ষা করে দেখাবেন যা তাঁর মাংস মানুষের খাবার উপযোগী কি না। এটা পর্যায়ক্রমে সারা দেশে বিস্তৃত হবে। লোকালয়ে কোন পশু পাখি জবেহ করা হবে না, বা করতে দেওয়া হবে না।

বাড়ি করার উপযোগী জমির স্বল্পতার কারণে ঢাকা সহ প্রায় প্রতিটি বড় বড় শহর এখন ইট পাথরে বস্তির শহরে রূপ নিয়েছে। বলতে গেলে তেমন কোন ফাঁকা জায়গা নেই। এই অবস্থায় ধর্মীয় আবেগ আর বিশ্বাস থেকে মানুষ কোরবানি দেন রাস্তায়। এছাড়া তাঁদের কোন বিকল্প নেই। কোরবানির বর্জ্য, ময়লা পানিতে ধুয়ে দেন তাঁরা ড্রেনে, সেখান থেকে যায় হয় স্ট্রম ওয়াটার ড্রেন বা সুয়েরেজ লাইনে। ফলাফল ভয়াবহ। স্ট্রম ওয়াটার ড্রেন বা সুয়েরেজ লাইন বর্ষায় বা ভারি বর্ষণে জ্যাম হয়ে নগরী জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হয়। কোটি কোটি টাকায় নির্মিত রাস্তা নষ্ট হয়, নষ্ট হয় লাখ লাখ কর্মঘন্টা। সব চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হল কোরবানির বর্জ্য, বিশেষ করে রক্ত, ঠিকমত পরিষ্কার না হলে তা থেকে রোগ জীবাণু ছড়ায়। অন্যদিকে মাংসের মান পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় আর বাণিজ্যিকভাবে পালিত পশুতে অপরিমিত বা বেহিসাবি এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে তা পশুর মাংস হয়ে মানব দেহে সঞ্চারিত হচ্ছে, স্টেরয়েড দিয়ে পশু মোটা তাজা করার ফলে সেটাও কোরবানির মাংসের মাধ্যমে আমাদের দেশে মানব দেহে ঢুঁকে আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ-নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক বলছেন,"কোরবানির পশুর রক্ত ধোয়ার পর পানিটা যদি কোন ড্রেনেজ সিস্টেমে চলে যায় তাহলে কিন্তু কোন সমস্যা নেই। কিন্তু যদি কোথাও জমে থাকে তাহলে আশঙ্কা থাকবে। তাই মানুষজনকে সতর্ক করার যে মেসেজটা আমরা বারবার দিচ্ছি সেটা হল কোথাও যেন পানি জমতে না পারে। জমে থাকা পানিতে যেকোনো ধরনের মশা বংশ বৃদ্ধি করতে পারে।"

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই কয়েক বছরের মধ্যে। তাই কোরবানির সংখ্যাও বেড়ে কোটি ছাড়িয়ে গেছে। রি লোকেশন আর অন্যসব কারণে রাতারাতি কিন্তু ট্যানারিগুলোর ক্যাপাসিটির সেই অনুপাতে বাড়েনি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে দাবী করেছে যে, বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোর চাহিদা কোরবানির সময় উৎপাদিত পশুর চামড়ার মাত্র ৪০ ভাগ। তাই তাঁদের চামড়া সংরক্ষণে খরচ বাড়ে। ফলে তাঁরাও চামড়া ব্যবসায়ীদের টাকা বাকী রাখে। ট্রিকেল ডাউন পদ্ধতিতে চামড়া ব্যবসায়ীরা ঠকাচ্ছেন এতিমদের হক কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার দামের সমমূল্যের পণ্য প্রায় বিনামূল্যেই নিয়ে নিচ্ছে। এতে হতদরিদ্র মানুষ হচ্ছে চরম ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু তাঁদের তো আর মিডিয়া নেই, নেই সোশ্যাল মিডিয়া, নেই এমপি মন্ত্রী! তাই তাঁদের মিনমিনে আওয়াজ কারো কানে পৌঁছায় না।

আমরা আমাদের দেশের কোনটা সম্পদ তা আমরা চিহ্নিত করতে পারি না বা জানি না। অভিজ্ঞরা বলেছেন যে, স্লটার হাউজের বেনিফিট বহুমুখী। তবু সংক্ষেপে বলতে গেলে -প্রথমত এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত বহু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। নগরী আবর্জনার হাত থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে। স্যুয়েরেজ সিস্টেম রক্ষা পাবে, রোগবালাই কম হবে। আমরা যেটাকে পশু পাখির আবর্জনা মনে করি তা দেশে ব্যবহার করেও প্রচুর পরিমাণে রপ্তানির সুযোগ হবে। একটা দুইটা উদাহরণ দিলেই তা বুঝা যাবে। যেমন সুস্থ পশুর নাড়ীর পেস্ট দিয়ে ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে ওষুধের ক্যাপসুলের ক্যাপ তৈরি হয়। ময়লা গুলো হয় জৈব সার। হাড়গুলোর আছে বহুবিধ ব্যবহার। একটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় হাস মুরগী বা পাখির পালক দিয়ে হয় দামী লেপ, তোষক, বালিশ। পাখি জাতীয় প্রাণীর পায়ের নখ আর ঠোঁটের পাওডার ব্যবহার হয় কসমেটিক্স ইন্ডাস্ট্রিতে বিশেষ করে লিপস্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে। পশুর রক্ত কিন্তু ফেলনা নয়, অনেক দামী যা আমরা পাণিতে ধুয়ে ড্রেনে ফেলে দিই। স্লটার হাউজে পশু জবেহ করলে পশুর চামড়া থাকে অক্ষত, ওয়েস্টেজ কমে যায়, মাংস সুন্দর করে কাটা হয়, অপচয় হয় না বললেই চলে। সঠিক ব্যবস্থাপনা আর রপ্তানির লিংক থাকলে এসব কারখানার বাই প্রডাক্ট দিয়েই কারখানার সমস্ত খরচ উঠে যাবার কথা। মাংস আর অন্যান্য পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আসবে বৈদেশিক মুদ্রা, ইত্যাদি নানা বেনিফিট।

প্রশাসনের আমলা অংশের আর ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা থাকলে দাতা সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় আগামী ৪/৫ বছরের মধ্যেই বড় বড় শরগুলোতে এটা করা সম্ভব। এই প্রকল্পে পিপিপি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার, ও বিনিয়োগকারীদের সাথে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি ব্যুরো, কৃষি দপ্তর, পশু সম্পদ দপ্তর, পরিবেশ দপ্তর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে। অন্য কোন স্টেক হোল্ডারকেও দরকারে যোগ করতে হবে। তবে এর মূল দায়িত্বে থাকবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, আর বেসরকারি উদ্যোক্তা।

যেহেতু জনশক্তি আর সীমিত সম্পদ আমাদের তাই এই সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে জনস্বাস্থ্যের কল্যাণ আর আর্থিক উন্নয়ন ছড়াও কত প্রকার লাভ হবে তা এখনই অনুমান করা যাবে না। তবে আমাদের লাভ লোকসানের হিসেবের খাতায় এই উদ্যোগে লোকসানের সম্ভাবনার চেয়ে লাভের অংকটা যে অনেক বড় হবে তা অনুমান করতে অনেকের কষ্ট হলেই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কষ্ট হয়নি। তাই তিনি সারা দেশে অত্যাধুনিক কসাইখানা বা স্লটার হাউজ বানিয়ে কোরবানির সময় দেশের গরীব মানুষের হক আদায় করবেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটা শক্ত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন। কোরবানি সহ পশু জবাই আর জনস্বাস্থ্য নিয়ে এটা প্রধানমন্ত্রীর নতুন চ্যালেঞ্জ!

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭