ইনসাইড থট

অসন্তোষের আগ্নেয়গিরি নিশ-পিশ করছে!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 19/08/2019


Thumbnail

অবশেষে ঘুম ভেঙ্গেছে প্রশাসনের, ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন জাতীয় সংগীত ও গোপালগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তনের ব্যানারটি নামিয়ে ফেললো, তখন। গোপালগঞ্জে টাঙ্গান হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন আর গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তনের দাবির ব্যানার! কি অবাক করা এই দেশের প্রশাসনের আমলা অংশের ঘুম আর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতাদের ঈদ নিদ্রা! তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলায়, এটা সহ্য করা যায়,নাকি হজম করা যায় এই মানসিক নির্যাতন! ইউরোপ আমেরিকা হলে এতক্ষণ টট আইনে শত শত মামলা হতে পারতো, মানসিকভাবে আঘাত দেবার জন্য। বাক স্বাধীনতা মানে একি স্বেচ্ছাচারিতা চলছে এই দেশে!     

মিডিয়া বিভিন্ন খবর থেকে জানা যায় যে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের হুজুগ তোলা বা চেষ্টা করা বাংলাদেশে কিন্তু এবারই নতুন নয়। আগেও চার চার বার রাজনৈতিকভাবে ও অন্যভাবে এ চেষ্টা চালানো হয়েছে। কোন ঘরানার মানুষ জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চায় তা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পূর্ববর্তী এই চেষ্টাগুলো থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত, রাজাকার আর ফ্রিডম পার্টির নেতারা সুযোগ পেলেই ছোবল দেয়, তাঁর নজির আছে কিন্তু তা নিয়ে কারো অজানা হাতের ছোঁয়ায় যড়যন্ত্রকারীরা বেঁচে যায় শাস্তি ছাড়া।

প্রথম চেষ্টা: জাতীয় সংগীত প্রথম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রপতির আসনে বসানো হয় খন্দকার মোশতাক আহমেদকে। ক্ষমতায় বসেই মোশতাক জাতীয় সংগীত বদলাতে চেয়েছিলো।

দ্বিতীয় চেষ্টা: জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে। সে সময় ‘আমার সোনার বাংলা’ কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়। সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’

ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ আজিজুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে। এসময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমানের নিহত হবার পর সেই উদ্যোগ থেমে যায়।

তৃতীয় চেষ্টা: তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে।

এবং এর সুপারিশ পত্র জমা দেয় তৎকালীন মন্ত্রী কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ।

চতুর্থ চেষ্টা: এই চতুর্থ চেষ্টাটি ছিল খুব কৌশলী। গোপালগঞ্জের ছেলে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে জি বাংলার সা রে গা মা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া নোবেল আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের চেষ্টাকারীদের পালে হাওয়া লাগায়। যে শিল্পীর গানের সাথে আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের তুলনা করে তা দেখে অনেকেই হতবাক হয়েছে। সাহিত্যিক গুণ বিচারে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের বাণী আর সুরের কাছে সেই গান কিছুই না।     

কারণ বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে যারা অবদান রেখেছেন, তন্মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হচ্ছেন পুরোধা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞও বটে। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজ করেন নি। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার অবিচল পদচারণই তাকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাঙ্গালীর ঘোরে এনেছিলেন সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার।

মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকেই গোপালগঞ্জ আর জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের যে ধুঁয়া যডযন্ত্রকারীরা তুলেছে তা হলে রাজা গোপালের নামানুসারে গোপালগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছে যিনি ধর্ম বিশ্বাসে ছিলেন হিন্দু। জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ধর্ম বিশ্বাসে তারা হিন্দু মনে করেন। কিন্তু দুর্মুখেরা জানেই না যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম, একেশ্বরবাদী, হিন্দু ধর্মাবলম্বী   নন। আর হলে কী উনি তো বাঙ্গালী। ১৪০৯ বছর আগে আমরা সবাই তো ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দু ছিলাম! তাই বলে কী আমাদের উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া আমাদের ধন সম্পদ সব ফেলে দিয়েছি! নাকি ফেলে দেবো!

ষড়যন্ত্রকারীরা পরিকল্পনা করেই জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করার মাধ্যমে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যত বেশি মানুষ শোনে, সেগুলো সত্যি বলে বিভ্রম তৈরি হয়। মনোবিজ্ঞানীরা একে `ইল্যুশন অব ট্রুথ` বলে বর্ণনা করেছেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ হ্যানকক বলেন, "আপনি কোন কিছু যত বেশি দেখবেন, তা তত বেশি পরিচিত মনে হবে। আর কোন কিছু যত বেশি পরিচিত মনে হবে, সেটি তত বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে।" দেখা গেছে, বার বার দেখা বিষয় মানুষ বেশি বিশ্বাস করে।

ডঃ পানটাজি বলেন, "ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কিন্তু সমাজের জন্য খুবই বিপজ্জনক। যারা বিশ্বাস করে যে টিকা দিলে শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হয় এবং শিশুদের টিকা দেয়া বন্ধ করে দেয়, তারা কিন্তু এসব শিশুকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।" যারা নিজেদের চালাক ভাবেন, যারা ভাবেন তাদের বোকা বানানো সম্ভব নয়, তাদেরও সতর্ক হওয়া দরকার। "কোন একটা বাড়ির মাটির নীচের ঘরে বসে ইন্টারনেটে নানা রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে, ষড়যন্ত্রতত্ত্বকারীদের ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষের ধারণাটা এরকম।" "কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ আসলে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পুরোপুরি বিশ্বাসও করে না, নাকচও করে না, তাদের অবস্থান এই দুয়ের মাঝামাঝি", বলছেন ডঃ বায়ফোর্ড।

তাই জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই জণগনের আকাংখ্যা সরকারকে, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের করতাদের বুঝতে হবে। তা না হলে জণমনে চরম অসন্তোষ দিন দিন বৃদ্ধি পাবে, নিশ-পিশ করছে, যা হতে পারে একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। জ্বালা মুখে হালকা আঘাতেই যা হয়ে উঠতে পারে চরম বিপর্যয়ের কারণ।   

তথ্যঋণঃ বিবিসি, Ajanta Deb Roy, অন্যান্য।

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭