ইনসাইড ইকোনমি

ট্যানারি মালিকদের ঘেরাটোপে বন্দি চামড়া ব্যবসা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 25/08/2019


Thumbnail

একসময় পাটের পরেই চামড়াকে এদেশের সব থেকে বেশি রপ্তানি আয়ের উৎস বলা হতো। চামড়াশিল্পে আয়ও হয়েছে প্রচুর। সময়ের সাথে সাথে এই চামড়া শিল্প ও ব্যবসা ত্বরান্বিতই হওয়ার কথা কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে উল্টো। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত যেই চামড়া ২৫০০ থেকে ৩ হাজারে বিক্রি হতো, সেই চামড়া  ২০১৩ সাল থেকে বিক্রি হচ্ছে ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায়। গত সাত বছরে এই চামড়ার দাম ধাপে ধাপে কমে এমন অবস্থায় এসে ঠেকেছে যে, বিনামুল্যেও ব্যবসায়ীরা আর চামড়া নেয় না। এবারের কোরবানির চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুতে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে দেশের বেশকিছু জায়গায়। চামড়ার দর এতটা পতনের কারণ কি হতে পারে আর সমস্যাগুলো ঠিক কোথায়? এগুলো জানতে বাংলা ইনসাইডার কথা বলেছে রাজধানীর লালবাগের পোস্তা মোড়ে শত বছর ধরে পারিবারিকভাবে চামড়া ব্যবসার সাথে যুক্ত কিছু ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের সাথে।

পয়ত্রিশ বছর থেকে চামড়া ব্যবসার সাথে যুক্ত এবং পঁচিশ বছর থেকে প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসা করছেন পোস্তার ফিরোজ। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কোন কোন সমস্যার কারণে বর্তমানে উদ্বুদ্ধ এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে? প্রশ্নের উত্তরে বাংলা ইনসাইডারকে তিনি বলেন, মূলত দুইটি প্রধান সমস্যার কারণে এইসব অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একটা সময় ছিলো আমাদের বাংলাদেশ থেকে মোট রপ্তানি চামড়ার সত্তর থেকে পঁচাত্তর ভাগ চামড়া চায়না আমদানী করতো। তারা সেগুলো তাদের মতো রিফাইন করে আমেরিকা, জার্মান ও ইতালিসহ বেশকিছু দেশে রপ্তানি করতো। কিন্তু বছর কয়েক আগে আমেরিকা এসব পণ্যের উপর ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়ায় চায়না আর মাল রপ্তানি করে সুবিধা করতে পারছে না। তাই তারা আমাদের দেশ থেকে চামড়া কেনা কমিয়ে দিয়েছে। যখন চামড়া কেনা কমেছে তখন তো দামে একটু হেরফের হবেই। এ কারণেই কি এবার চামড়ার এই বেহাল দশা? জিজ্ঞেস করা হয় তাকে। তিনি তেমনটা মনে করেন না বলে আরো যোগ করেন, ‘গত নব্বই সাল থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে মধ্যস্বত্বভোগী ও ক্ষুদে চামড়া ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে আছে। নগদ টাকা দেওয়ার কথা বলে চামড়া নিয়ে গেলেও আজ প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেছে সেই টাকা এখনো পাইনি আমরা। আমরা তো মধ্যস্বত্বভোগী, আমাদের মাধ্যমে চামড়া বিক্রি হয় এবং আমাদের হাতেই প্রথম টাকা আসে ট্যানারি মালিকদের থেকে। আমাদের থেকে যখন নগদ টাকা দেওয়ার কথা বলে চামড়া নিয়ে গিয়ে সেই টাকা আর দেওয়ার নাম করে না ট্যানারি মালিকরা। তখন তো সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। ত্রিশ বছরে যে চারশত কোটি টাকা ট্যানারি মালিকরা বকেয়া রেখেছে সেই টাকাটা আমরা মধ্যস্বত্বভোগীরা পাওনা, এটা বলা হয়। আসলে এই টাকাগুলো কিন্তু ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের। একটা ক্ষুদে ব্যবসায়ী যদি ত্রিশ বছর থেকে চামড়া কেনার জন্যে নিজের গাট থেকে পয়সা বিনিয়োগ করতে থাকে আর সেই টাকা যদি প্রতি বছরেই আটকে রাখে ট্যানারি মালিকরা তাহলে তারা নতুন পুঁজি খাটাতে পারে না। ত্রিশ বছর পুঁজি খটিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছে। হাতে টাকা না থাকায় এইবার আর ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে যায়নি কোথাও। যখন ক্ষুদে ব্যাবসায়ীরা চামড়া কিনতে যাবে না তখন তো চামড়া ফেলেই দিতে হবে। ক্ষুদে ব্যবসায়ীরাই তো চামড়ার প্রাথমিক পর্যায়ের ক্রেতা। ক্রেতা না থাকলে পণ্য তো নষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন ট্যানারি মালিকরা চাইলে এই সমস্যা নিমিষেই সমাধান হয়ে যাবে।

কথা হয় ক্ষুদে ব্যবসায়ী সাইদুর রহমানে সাথে। বিগত ২০ বছর থেকে মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া কিনেছেন এই যুবক। এবার তার হাতে টাকা না থাকায় চামড়া কিনতে পারেননি। তিনিও ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করে বললেন, তারা কেন টাকা বকেয়া রাখে এটা আমার বোধগম্য নয়। চামড়া শিল্পের যত সুবিধা আছে সব সুবিধাগুলো এই ট্যানারি মালিকরা ভোগ করেন। তিনি জানান যে, ট্যানারি লসে আছে জানিয়ে আমাদের থেকে চামড়া কেনেন না অথচ তারা ঠিকই বিদেশ থেকে চামড়া আমদানী করেন। প্রত্যেকটা ট্যানারির মালিক চামড়া ব্যবসা করার জন্যে সরকারি লোন করে থাকেন শত শত কোটি টাকা। তিনি বলেন, চৌধুরী ট্যানারির মালিক চামড়া ব্যবসা করার জন্যে ছয় থেকে ৭০০ কোটি টাকা সরকারী লোন করেছেন আবার ক্রিসেন্ট ট্যানারির মালিক লোন করেছেন ১৮০ কোটি টাকা। আমরা পাই ৪০০ কোটি টাকা। তারা লোন করছে ঠিকই কিন্তু আমাদের টাকা দিচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, চামড়া তো আমাদের দেশের রপ্তানি পণ্য। তাই, এটা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের থেকেও রিপিড পায়। রিপিড হলো ভর্তুকি। সরকার তাঁদের সব ধরনের সুবিধা দিচ্ছে অথচ আমরা টাকার অভাবে মাল কিনতে পারছি না।

কথা হয় পোস্তার আরও কিছু ক্ষুদে চামড়া ব্যবসায়ীর সাথে। এদের অনেকেই এখন আর এই পেশার সাথে  সম্পৃক্ত নন। অনেকেই পুঁজি খাটিয়ে নিঃস্ব হয়ে রিকশা-সিএনজি চালাচ্ছেন আবার কেউ কেউ দারোয়ানের চাকরিও করছেন। তাঁদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চামড়াটা মুলত কাঁচামাল হওয়ায় সব থেকে বড় অসুবিধায় পড়েন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। তারা চামড়া কিনে যখন প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণের জন্যে পোস্তায় নিয়ে আসেন তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা সেটা বড় জোর একমাস রাখতে পারেন লবণ দিয়ে। তারপর সেগুলো ট্যানারি মালিকদের কাছে দিয়ে দিতে হয়, না হলে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই যে নষ্ট হয়ে যায়, এই সুবিধাটাই নেয় ট্যানারি মালিকরা। তারা ছাড়া এগুলো প্রক্রিয়াজাত করার মতো কোনো রাস্তা না থাকায় তারা ইচ্ছেমতো চামড়া নেয় এবং মনে চাইলে টাকা দেয় না চাইলে দেয় না।

এসব ব্যাপারে বিগত কয়েক বছর থেকে ট্যানারি মালিকদের বক্তব্য একই রকম। তারা বলেন, নিজেদের তহবিল সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য কম আর কোরবানিতে মানসন্মত চামড়া খুব কম আসে। যেগুলোর আন্তুর্জাতিক বাজারে দাম খুব কম হয়। অথচ মধ্যস্বত্বভোগীরা বলছেন, এই কোরবানিতে যে চামড়া আসে সেগুলোর সত্তর ভাগ চামড়ার মান ভালো। এক সাবেক ক্ষুদে ব্যবসায়ী বলেন, আসলে এই ব্যবসাটা এখন ট্যানারি মালিকদের ঘেরাটোপে বন্দি। বোঝা যায় এখানে বন্দি তবুও সেখানেই ঘুরপাক খেতে হচ্ছে বার বার।

 

বাংলা ইনসাইডার/এনএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭