ইনসাইড থট

গ্যাঁড়াকলে মোদী সরকার!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 06/09/2019


Thumbnail

বিদেশী চিহ্নিত করা নিয়ে পরিচালিত এনআরসি নিয়ে বাঙ্গালি অধ্যুষিত ভারতের আসাম, পশ্চিম বাংলা সহ গোটা দেশ জুড়ে চলছে চরম আতংক, নানা আলোচনা, সমালোচনা, হুমকি-ধামকি আর বিতর্ক। এই সাথে হালে যোগ হয়েছে কাশ্মীর ইস্যু যা দেশ বা অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে আছড়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ায়। চুল চেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে কাশ্মীর ও আসাম ইস্যুতে মোদী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের। কাশ্মীর আর আসামের মানুষের মনের মধ্যে জ্বলছে হতাশা, ক্ষোভ আর আতংকের, ক্রোধের আগুন। যার হল্কা এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভারতের বাংলাভাষী অধ্যুষিত এলাকা, ঘৃণা ও ক্ষোভ বাড়ছে বাংলাদেশেও।

নির্বাচনে জেতার লক্ষ্যে বিজেপি আসাম থেকে বাঙ্গালি মুসলিম তাড়ানোর অপ্রকাশিত এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামলেও মুখে মুখে বিদেশী খেদাও স্লোগান দেয়। আসলে তাদের লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘুদের আসাম তথা গোটা ভারত থেকে বিতাড়িত করা। এই সংখ্যালঘুর সমীকরণ বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্নভাবে নিয়েছে। কোথাও ভাষাগত সংখ্যালঘু কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ট্রাম্পকার্ড খেলেছে তারা। এটা যে কি ভয়াবহ ঝুঁকির তখন তারা হয়তো অনুমান করতে পারেনি তা বা এবারের মত ক্ষমতার মসনদ ধল করতেই এটা করেছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মিথ্যাচারের কুয়াসা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে তা পরিষ্কার হচ্ছে ভারতবাসী তথা গোটা দুনিয়ার কাছে।

ব্রিটিশ ভারতের তখনকার ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ, তার লেখা ১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট পাঠানো এক চিঠিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে সরিয়ে নয়া দিল্লি নেওয়ার প্রস্তাব করে। নানা কারণে যার বাস্তবায়ন হয় ১৯৩১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। ভারতের রাজধানী হিসেবে কোলকাতার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে স্বভাবতই চলে এসেছিলো বঙ্গভঙ্গের বিষয়টি। কারণ বঙ্গভঙ্গের আগে ও পরে বঙ্গভঙ্গ আর ব্রিটিশ বিরোধী যত আন্দোলন হয়েছিলো তার নেতৃত্বে একাট্টা ছিল ভারতের বাঙ্গালিরা। তাই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা শুধু বাংলাকে ভাগ করেই ক্ষান্ত হয় নি তারা তৎকালীন ভারতের শস্যভাণ্ডার খ্যাত পাঞ্জাবকেও ভাগ করেছিলো যাতে পরবর্তীতে ভারত পাকিস্তানে কোন আন্দোলন না হয়। ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ এর এই ফর্মুলায় তৎকালীন ভারত পাকিস্তানের নেতাদের সাথে গোপন চুক্তিতে এই ভাগ হয়েছিলো বলেও অভিযোগ আছে। কারণ বাংলার সাথে পাঞ্জাব ভাগ।

ব্রিটিশরা কি এমনিতে ভারত পাকিস্তান ভাগ করেছিলো! না, কারণ ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল কলকাতা ব্রিটিশদের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। সবাইকে ইঁদুরের মতো মরতে হবে। তাই পালিয়েছিল সেদিন। তার বদলা নিয়েছিল ১৯৪৭ সালে। ১৯০৫ সালের ব্যর্থতার বদলা। ১৯০৫ সালে বাঙালিকে ভাঙতে পারেনি। সেই ভয়ে দিল্লিতে পালিয়ে গিয়ে হিসাব বুঝিয়ে দিল। বাংলাদেশকে নিজেদের দাবি করা ব্রিটিশদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশ ব্রিটিশরা তৈরি করেনি। বাংলাদেশ বাঙালিরা সৃষ্টি করেছে। এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পরে সব চেয়ে অধিক সংখ্যক বাঙ্গালি ভারতে গিয়েছিলো। যারা গিয়েছিলো এবং ভারতে ছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রিফিউজি হয়ে তারা তো আর বাংলাদেশের নাগরিক ছিল না, ছিল পাকিস্তানি নাগরিক। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার পরে যারা মনে প্রাণে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি তারা সদ্য স্বাধীন বাংলায় ফেরেনি। বাকীরা, বিশেষ করে বাঙ্গালিরা, দলে দলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।

অখণ্ড ভারতের ইতিহাস এবং তৎপরবর্তী ১৯৭১ সাল তার প্রমাণ করে অনেক কিছু। বিদেশী অনুপ্রবেশের বাহানায় ভাষাগত সংখ্যালঘু বাঙ্গালি নিধন বা বিতাড়ণ অপচেষ্টা যে নানামুখী বিপদ এনে দেবে মোদী সরকার তার আঁচ করেছে ইতোমধ্যেই। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের পদক্ষেপে ক্ষেপে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বললেন, "ভারত-পাকিস্তান ব্রিটেনের অংশ"। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, “ভারত যদি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরকে ভারতের অংশে বানাতে পারে, ব্রিটিশ সরকারও ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স অ্যাক্ট -৪৭’ বাতিল করে ভারত-পাকিস্তানকে ব্রিটিশের অংশ বানাতে পারবে। এখানে কোনো দেশ পানি ঘোলা করতে পারবে না। কারণ এটা ব্রিটেনের আভ্যন্তরীণ বিষয়”। এটা কি শিশু ভোলানো কথা! নাকি মোদী ও এমরান খান সরকারের কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় শেখানো বুলি! নাকি কাশ্মীরী বা বাঙ্গালীর আন্দোলনের মোড় অন্যদিকে ঘোরানর জন্য! সন্দেহ আছে মনে।

অন্যদিকে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে যে, অবশেষে নতি স্বীকার করল হংকং প্রশাসন। টানা কয়েক মাসের বিক্ষোভ ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় চীনশাসিত হংকং প্রশাসন। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে এরই মধ্যে বিতর্কিত প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা দিয়েছেন হংকংয়ের প্রশাসনিক প্রধান ক্যারি ল্যাম।

চলতি বছরের এপ্রিলে হংকং পার্লামেন্টে একটি প্রত্যর্পণ বিল আনে সরকার। ওই বিল অনুযায়ী, চীন চাইলে হংকংয়ের কোনও বাসিন্দাকে নিজেদের ভূখণ্ডে নিয়ে গিয়ে বিচার করতে পারবে। অর্থাৎ হংকংয়ের বাসিন্দাদের নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার একটি আইনি পথ বের করার চেষ্টা করছিল চীন।

বিলটি পাস হলে আইনি সুযোগ নিয়ে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের চীন নিজেদের ভূখণ্ডে নিয়ে গিয়ে কমিউনিস্ট বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী নির্যাতন ও হয়রানি করতে পারে এমন আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। একদিকে হংকংকে স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্যদিকে এমন বিল পাস করানোর অপচেষ্টাকে হংকংয়ের ওপর কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত চীনা সরকারের আরও বেশি দমন-পীড়নের হাতিয়ার মনে করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে হংকং-বাসী।

টানা পাঁচ মাস হংকং কার্যত অচল করে দেন সেখানকার বাসিন্দারা। আন্দোলনকারীদের দাবি প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহার এবং বিক্ষোভে পুলিশের নৃশংসতার অভিযোগের বিচার করতে হবে। প্রবল আন্দোলনে চাপের মুখে জুন মাসে বিলটি স্থগিত করে হংকং সরকার। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাতেও দমেনি। এরই মধ্যে বিক্ষোভে পুলিশি হস্তক্ষেপের জেরে আন্দোলনের মাত্রা তীব্রতর হয়। ক্লাস বয়কট করে আন্দোলনে যোগ দেয় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অবশেষে চাপের মুখে বিলটি প্রত্যাহার করল হংকং সরকার।

মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করার জন্য বাহানার অভাব হয় না। যেমন ধর্মীয় বিভাগ- হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইত্যাদি। বর্ণ বা শ্রেণিগত বিভাগ: মুসলমানদের যেমন-শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানী, ওয়াহবি, ইত্যাদি। একইভাবে হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, সিডিউল কাস্ট, ইত্যাদি। রাজনৈতিক ভাগ হচ্ছে- অমুক দল, তমুক দল, ইত্যাদি। আবার ভাষাগত বিভাগ- বাঙ্গালি, বিহারী, পাঞ্জাবী, হিন্দি, উর্দু, বেলুচ, পস্তু, ইত্যাদি। এসব ভাগের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ধর্মীয়, ভাষাগত, গোষ্ঠীগত, রাজনৈতিক, ইত্যাদি সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলে তাঁদের শোষণ বা সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে লাভবান হওয়া।

আসামে বিদেশী চিহ্নিত করা নিয়ে পরিচালিত এনআরসি নিয়ে বিজেপি’র গোপন প্রচারণা ছিল আসলে বাঙ্গালি মুসলমানদের বাদ দেওয়া, বিশেষ করে বাঙ্গালি মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণ করে তাঁদের সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রহীন করে দিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে মানবেতর জীবন উপহার দেওয়া। কিন্তু চূড়ান্ত হিসেবে দেখা গেল যে, বিজেপি গোপনে দেওয়া তাঁদের কথা রাখেনি। মোটাদাগে যে ১৯ লাখ মানুষ বাদ পড়েছেন তারা সবাই বাঙ্গালি কিন্তু সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ১১ লাখ হিন্দু বাঙ্গালি। এরাই একচেটিয়া ভোট দিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছে ঐ রাজ্যে। মুসলমান বাঙ্গালি ৬ লাখের মত, বাকীরা অন্য ধর্মাবলম্বী বাঙ্গালি। এখানেই শেষ না, অনেক মন্ত্রী, বিধায়ক, সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ির লোকেও বাদ পড়েছেন এই এনআরসিতে। এমনও দেখা গেছে যে, পরিবারের ৭ জনের ১ জন কনিষ্ঠ সদস্য বাদ, বাকীরা ঠিক আছে। নামের বানান ভুল, বাবার বা ঠাকুরদাদার নামের বানানে ভুল, ইত্যাদি ঠুনকো কারণেও বাদ পড়েছেন অনেকে। পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালি মেয়ে বা ছেলে বিয়ে করে আসামে সেটেন্ড করেও বাদ পরেছেন এনআরসি থেকে। বাবা আছে তো ছেলে নেই, ছেলে আছে তো মেয়ে নেই, ইত্যাদি অবস্থা। এটা আসাম তথা বাংলার মানুষের কাছে এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে যে বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকায় এনআরসি আদতে বাঙ্গালি খেদাও প্রকল্পের ভিন্ন নাম।

এই লেখা যখন শেষ করি তখন দেখলাম ভারতের বিজেপিশাসিত আসমে এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর থেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। তাদের দাবি, চূড়ান্ত তালিকায় হিন্দুদের নাম বেশি বাদ দেয়া হয়েছে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে আন্ত রাষ্ট্রীয় হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে আজ শুক্রবার সকাল ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত করিমগঞ্জ জেলায় বনধের ডাক দেয়া হয়েছে। এতে কী শেষ রক্ষা হবে!

যা হোক, ব্রিটিশ আর বিদেশী বেনিয়া তাড়ানো বা পাকিদের ঝেটিয়ে বিদায় করা বাঙ্গালি এতো সহজে যে বাঙ্গালিদের জন্য করা তাঁর এনআরসি করা মেনে নেবে না তা মোদী সরকার বুঝে ফেলেছে। তারা কি অবশেষে হংকং এর মত আসামে চালিত এনআরসি থেকে সরে আসবে। পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যা বলছেন, তাতে মোদী সরকার চরম গ্যাঁড়াকলে এখন। দেখা যাক কি হয়, এনআরসি’র নামে মোদী সরকারের পরিচালিত বাঙ্গালি নির্মূল প্রকল্পের!


বাংলা ইনসাইডার/এমআরএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭