ইনসাইড থট

মাফিয়ার কবলে বাংলাদেশের বীজ সেক্টর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 11/09/2019


Thumbnail

বালিশ, বই, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির পরে এবার ৩ কোটি টাকা মূল্যের হাইব্রিড ধানের বীজ নিয়ে দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়েছে। বিএডিসি’র ঝিনাইদহের দত্তনগর খামারে এই দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এগুলো অনেকের চোখে ছোট হলেও বাস্তবে এই খাতে দুর্নীতি এত বড় বড় যে তাঁকে শুধু দুর্নীতি না বলে কেউ বলছেন দিনে দুপুরে কলমের খোঁচায় ডাকাতি বা তার চেয়েও বেশি কিছু। যে কয়টি বিভাগের দুর্নীতির খবর এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে, দুর্নীতি শুধু এই কটা বিভাগেই সীমিত নেই, এটা যে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরকে ঘিরে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে তাতে এক শ্রেণীর আমলা আর রাজনীতিকদের সন্দেহ থাকলেও সাধারণ মানুষের নেই।         

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, স্বাস্থ্য দপ্তরের অনেক কথাই প্রকাশ হয়েছে, দেশের মানুষ তা জেনেছেন, কীভাবে কীভাবে ৫ শ’ কে ৫০ হাজার বা ৫লাখ কে ৫ কোটি করা হয়েছে। তবে কৃষি দপ্তরের বীজ নিয়ে বিএডিসি’র ঝিনাইদহের দত্তনগর খামারে যে কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছে বাস্তব অবস্থা তাঁর চেয়ে অবস্থা আরও ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেছেন বীজ উৎপাদনের লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যবসায়ী সূত্রে।     

উর্বর জমি, পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থা ও উন্নত খামার ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ইত্যাদি সব কিছু অণুকুলে থাকলেও শুধু বীজ খারাপ হলে কৃষক তার সঠিক উৎপাদন পান না। আর গরীব কৃষক একবার ফসল উৎপাদনে মার খেলে তা পুষিয়ে নিতে কম করে হলেও ৩ মওসুম লাগে। উন্নত বীজ তাই এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। একটু কষ্ট করে আমরা তাই বীজের শ্রেণিবিভাগ জেনে নিই, পরে বুঝতে সহায়ক হবে।   

কৃষির মূল উপকরণ হচ্ছে বীজ। বীজ বলতে আসলে অনেক কিছুই বোঝায়। ফসলের যে কোনো অংশ, দানা অথবা অঙ্গ যেটি অনুরূপ একটি ফসল পুনঃ উৎপাদনে সক্ষম তাকেই বীজ বলে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশের বীজ বিধিমালা ১৯৯৮ মোতাবেক বীজের ৪ (চার) টি শ্রেণি বিভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-প্রজননবিদের বীজ : গবেষণাগারে বীজ প্রজননবিদের এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত জাতের বীজের মূল বীজ গবেষণা কেন্দ্রের বীজ ব্যাংক থেকে সংগ্রহপূর্বক পরিবর্ধন করে এই বীজ উৎপাদন করা হয়। এই বীজ খুবই অল্প পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং তা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। এই বীজ থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা যায় বলে সরকারী সূত্রে দাবি করা হয়।

ভিত্তি বীজ: প্রজননবিদের বীজের পরবর্তী স্তর ভিত্তি বীজ যা বীজ প্রযুক্তিবিদদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদন করা হয়। আমাদের দেশে মূলত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) তাদের নির্ধারিত খামারে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করে। তবে গত কয়েক বছর ধরে কিছু বেসরকারি বীজ কোম্পানি এবং সংস্থাকে সরকারি বিধি বিধান পালন সাপেক্ষে ভিত্তি বীজ উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। ভিত্তি বীজ জাতীয় বীজ অনুমোদন সংস্থা কর্তৃক অবশ্যই প্রত্যয়িত হয়ে থাকে।

প্রত্যয়িত বীজ: ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। বিএডিসি`র নিজস্ব খামার সমূহে এবং কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স জোন সমূহে প্রত্যয়িত বীজ উৎপাদিত হয়। জাতীয় বীজ নীতি অনুযায়ী প্রত্যয়িত বীজ সরকারি বীজ অনুমোদন সংস্থা কর্তৃক প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক নয়।

মান ঘোষিত বীজ: ভিত্তি বীজ বা প্রত্যয়িত বীজ থেকে মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন করা হয়। বিএডিসি কৃষক পর্যায়ে বিপণনের জন্য যে বিপুল পরিমাণ বীজ উৎপাদন করে তা এই শ্রেণির। বেসরকারি খাতের ছোট বড় কোম্পানিগুলো আজকাল মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন করে বিপণন করে থাকে। এসব বীজ উৎপাদনে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়ন পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। তবে বীজের গুণগত মান নিশ্চিত কল্পে এবং কৃষদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের যে কোনো পর্যায়ে বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির পরিদর্শকগণ বীজ পরীক্ষা করতে পারেন। নির্ধারিত মান লঙ্ঘিত হলে সরকারি আইন অনুযায়ী জরিমানা ও শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।  

উন্নত মানের বীজের বৈশিষ্ট্য: আমাদের দেশের বীজ শিল্পের বহুল প্রচলিত স্লোগান হচ্ছে, ‘ভালো বীজ ভালো ফসল’। ভালো বীজ মানে উন্নতমানের বীজ। মান সম্পন্ন বীজ বিভিন্ন শ্রেণির হতে পারে যেমন- মৌল বীজ, ভিত্তি বীজ, উন্নত মানের বীজ, হাইব্রিড বীজ, ইত্যাদি।

মান সম্পন্ন বীজ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বিশুদ্ধ বীজ (কম পক্ষে ৯৪% বিশুদ্ধতা)। উজ্জ্বল, সুন্দর, সতেজ, স্বাভাবিক রঙ এর বীজ। পুষ্ট, বড় দানা সম্পন্ন বীজ। পোকা ও রোগ মুক্ত বীজ। বীজের আর্দ্রতা সর্বোচ্চ ১২% (ধান, গম) অন্যান্য ফসল ১০%। অঙ্কুরোদগম বা গজানোর ক্ষমতা ৭০-৮৫% এর উপরে। বীজের ক্ষতিকর আগাছার বীজ থাকবে না।  

আইনে বেসরকারি খাতের ছোট বড় কোম্পানিগুলো মান ঘোষিত বীজ উৎপাদন করে বিপণন করার কথা থাকলেও তারা আসলে কতটুকু পরমান বীজ উৎপাদন করে তা মেহেরপুর জেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে গেলে টের পাওয়া যাবে। নিজের খামার বা চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে বীজ উৎপাদন করার কথা থাকলেও বাস্তবে চুক্তিবদ্ধ চাষির তথ্যে চরম গোলমাল আছে। তাছাড়া খামার বা চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে পাওয়া বীজের চেয়েও অনেক বেশি বীজ কোম্পানিগুলো বিক্রি করে। কীভাবে সেটাই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। বিএডিসি’র খামারে যে পরিমাণ বীজ উৎপাদিত হয় তার একটা বিরাট অংশ ‘নন সীড বা মান সম্মত সীড নয়’ বলে সাধারণ ফসলের দরে অর্থাৎ কম দামে বিভিন্ন ‘মাফিয়া বীজ কোম্পানির’ কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। যেহেতু এটা হয় গোপনে অনৈতিক যোগসাজশে তাই এর পরিবহণ, সংরক্ষণ যথাযথ হয় না, যার ফলে চাষিগণ প্রতারিত হন। বিএডিসি’র এই কর্মকাণ্ডে নিজেরা বা চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন করে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো বাজারে টিকতে পারেনি, অনেকেই হারিয়ে গেছে। যদিও এই দফায় ধরা পড়েছে মাত্র তিন কোটি টাকার বীজ কিন্তু বাস্তবে এভাবেই বিএডিসি’র মাধ্যমে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার বীজ পাচার হয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে।  

উৎপাদনের পরে বীজ সংরক্ষণ মৌলিক তত্ত্বের একটি প্রধান নীতি হলো, যে গুণগত মান নিয়ে বীজ গুদামে ঢোকে, বাহিরে আসার পর সে মান তার চেয়ে ভালো নাও হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, বীজ যতই ভালো হোক না কেন তা যদি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা না যায় তবে সে বীজ ভালো থাকবে না। সরকারী সূত্রে দাবি করা হয় যে বাংলাদেশের মোট বীজ চাহিদার প্রায় ৯০% কৃষক নিজেদের উৎপাদিত বীজ দ্বারাই নিজেদের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। তাহলে বাস্তবে মান সম্মত বীজ উৎপাদন ১০% বা এরও নীচে করেন বিএডিসি ও কোম্পানিগুলো। কারণ বেশ কিছু বীজ আমদানি করা হয় যা সবার জানা। কৃষি দপ্তরের দাবি হচ্ছে কৃষক উৎপাদিত এসব বীজ প্রকৃত গুণগত মানসম্পন্ন নয় বলে অধিক ফলন লাভ প্রায় অসম্ভব। কারণ একজন চাষি সঠিক পদ্ধতিতে বীজ উৎপাদন করলেও তাঁর পাশের ক্ষেতের চাষি তা না করলে ক্রসপলিনেশনের কারণে বীজের শুদ্ধতা থাকে না। এর পরে যারা বাজার থেকে বীজ কেনেন সেখানেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি। কারণ মান ঘোষিত বীজ যা কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয় তার জন্য বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়ন পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়।     

সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল একটা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ও একাউন্টিং চীফ হচ্ছেন সচিব সাহেব। কিন্তু দুর্নীতির ঘটনায় তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। কিছু সংবাদ কর্মী জেনে বা না জেনে প্রশাসনের রাজনৈতিক অংশের রাজনিতিকদেরই শুধু এসব দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করেন, কিন্তু সচিবগণকে করেন না। কেন করেন না তার কারণ অজ্ঞাত।

প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে `জিরো টলারেন্সের` কথা বললেও যারা এটি বাস্তবায়ন করবেন, তাদের একটি অংশের (রাজনৈতিক) মধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির ঘটনাগুলোকে আগ বাড়িয়ে বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়ের আমলা প্রস্তুত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তা অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরণের বক্তব্য যখন আসে তখন আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যারা জড়িত, বিচারিক কিংবা তদন্ত প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত তাদের কাছে এক ধরণের ভুল বার্তা পৌঁছায়’।

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭