ইনসাইড থট

দুর্নীতিবাজদের সাথে আপোষ নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/09/2019


Thumbnail

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিতে যাচ্ছে তা অনুমান করা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ অনেকেই আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জানেন যে এই কাজের জন্য তাকে চরম কঠিন সময় পার করতে হবে। তবুও তিনি তাঁর কার্যালয়ে একটি দুর্নীতি বিরোধী টাস্কফোর্স গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সবগুলো টেন্ডার প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্ভব ‘ই টেন্ডার’ এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কতটুকু কাজ করছে। কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সে ব্যাপারে প্রতিবেদন দিতে হবে। সেই সাথে ই টেণ্ডারের সার্ভার থেকে অনেক সংযুক্তি মুছে ফেলে অনেক টেন্ডারকে নন রেস্পন্সিভ বা অযোগ্য করা হয়। সেটা যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবছেন তিনি।

প্রত্যেকটি টেন্ডারে প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণের আগে পণ্য বা মালের বাজার যাচাই করা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শুধু বাজার যাচাই করলেই হবে না। তা যেন বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবুও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদকের নাম, কান্ট্রি অফ অরিজিন, স্পেসিফিকেশন যেন ঠিক থাকে। সেবা হলেও একই ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সরকারী কর্মকর্তা দিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করলে ‘কাউয়ার মাংস কাউয়ায় খাবে না’ অবস্থা দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুব বেশি। অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। তাই সেখানে বিচার বিভাগ, রাজনীতিক, উন্নয়ন কর্মী, সাংবাদিক, সমাজকর্মীও থাকেন তা নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে বিশেষ আদেশ জারি করা যাতে বলা থাকবে যে, “এতদবিষয়ে পূর্বের যে কোন আইনই থাকুক না কেন” কথাটা জুড়ে দিয়ে প্রয়োজনে আইন করা হবে যাতে আইনের ফাঁক গলে কেউ বেরুতে না পারে।

সরকারী টেন্ডারগুলোতে যেন এ ধরণের অনিয়ম না হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি মনিটরিং সেল খোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই মনিটরিং সেলে নিয়োজিতগনেরা যেন সবাই সরকারী কর্মচারী না হন। সেখানে সরকারী কর্মকর্তার পাশাপাশি বিচার বিভাগ, সিইজিআইএস বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিক, উন্নয়ন কর্মী, সাংবাদিক, সমাজকর্মীও থাকেন তা নিশ্চিত করা হবে যাতে সম্পর্কের সূত্র ধরে কেউ মাফ বা পায়।

প্রত্যেকটি টেন্ডারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টেন্ডারের জবাবদিহিতা বলতে কাজ পাওয়ার পরে বাস্তবায়নে জবাবদিহিতাও দেখা হবে খুব কঠিন কঠোর ভাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন যে, সারাদেশে যে উন্নয়নষজ্ঞ হচ্ছে তার সুফল মানুষ পাবে না যদি না এই সমস্ত অনিয়ম এবং দুর্নীতিগুলো বন্ধ না হয়। তাই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত মন্ত্রণালয়/ বিভাগ/ দপ্তরের কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়ে খেয়াল রাখা জরুরী তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে-

টেণ্ডার ডকুমেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা যথা সম্ভব পরিহার করা। টেণ্ডার ডকুমেন্টের অস্বচ্ছতার সুযোগ নিয়ে অসৎ লোকেদের সিণ্ডিকেট দুর্নীতির সুযোগ পায়।

সীল্ড টেণ্ডার ডকুমেন্ট দাখিল করার পরেও এক শ্রেণীর কর্মকর্তা দরপত্র প্রদানকারীদের সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে অন্যকে দেয়। তারা একাধিক ব্যক্তির সাথে অফিশিয়াল মিটংএর নামে এই যোগাযোগ রাখে কখনো সরাসরি, কখনো এজেন্টের মাধ্যমে। এটা খুব কমন এখন।

অসচ্ছল ব্যক্তি বা কোম্পানিকে কাজ দিয়ে সময় নষ্ট করে। কিন্তু তাঁর জন্য কোন নানা অজুহাত খাড়া করা হয়। যদিও বাছাই পর্বে তাঁদের যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য ব্যাপক ক্ষতি হয়, সরকারের সার্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না, জিডিপিতে প্রভাব ফেলে।

টেণ্ডার ডকুমেন্ট তৈরিতে পণ্য বা উপাদানের স্পেসিফিকেশন, কান্ট্রি অফ অরিজিন, ইত্যাদিতে ঘাপলা করা যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐ পণ্য পাওয়া না গেলে তাঁর বিকল্প কী তাও নির্ধারণ করে দিতে হবে।

আমরা দেখেছি যে, হাসপাতাল কিংবা জেলখানায় বাজার দরের চেয়ে কম দামে মূল্য কোট করে সরবরাহকারীগন কাজ নেয়। তাঁরা কী লস দেওয়ার জন্য কাজ নেয়? নাকি সরবরাহের সময় তাতে থাকে বিরাট ফাঁকি- সেটা মানে আর পরিমাণেও।

বিভিন্ন ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির চিত্র ভিন্ন। আমরা একটা অবকাঠামো তৈরির প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির খণ্ড চিত্র বা কিছু ইঙ্গিত দিতে পারি। মনে করি কোন এলাকায় ২টা ব্রীজ হবে সাথে ব্রিজের এপ্রোচ রোডের জন্য কিছু নতুন রাস্তা হবে, তাই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এই কথা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দপ্তরের মাধ্যমে চলে যার সংশ্লিষ্ট ডিসি অফিসে, এসি ল্যাণ্ড অফিসে। প্রকল্প অনুমোদনের নিশ্চয়তা পেলে এসি ল্যাণ্ড (যদি অসৎ হন) আর তার দালালেরা রাতারাতি সম্ভাব্য অধিগ্রহণ এলাকায় টিন সেড বাড়ি তরী করে, কাঁচা বাড়ি তৈরি করে সয়লাব করে ফেলে। কারণ ক্ষতিপূরণ ৩০০%। কিন্তু সেই টাকার প্রায় সিংহভাগ চলে যায় এসি ল্যাণ্ড আর তার দালালের কাছে। কারণ জমির মালিকগণ অধিকাংশই পৈত্রিক সূত্রে জমির মালিক। না থাকে নাম জারি করা না থাকে খাজনা পরিশোধ। এটা করতে গেলে স্থানীয় তহসীল অফিস, যা এসি ল্যাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে, যে হয়রানী করে তা বর্ণনার অযোগ্য। মানুষে বেঁচে থাকতে হয় তাঁদের সন্তানদের জন্য তাই তাঁরা এটা সহ্য করেন, তা না হলে কী হতো বলা মুশকিল। এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস সেন্টার (সিইজিআইএস) এর সাহায্য নিলে এই শয়তানী বা দুর্নীতি করা বন্ধ করা যায়।

সব কাহিনী বলতে গেলে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’এর মত বিশাল উপন্যাস লিখতে হবে। যা হোক, মনে করুন রাস্তা বা ব্রিজের ডিজাইন করার জন্য মাটি পরীক্ষা করা দরকার। মনে করুন ১০০০ পয়েন্টে সয়েল টেস্ট করতে হবে। যে কোম্পানি কাজ পেলো তাকে বেছে বেছে ২০০ থেকে ২৫০ টি বোরিং করে সয়েল টেস্ট রিপোর্ট দিতে বাধ্য করা হয়। এটা বাকী বোরিং এর খরচ আর ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট দুটি হয় মন গড়া। প্রকল্প বাস্তবায়নে যার প্রভাব পড়ে, কখনো খরচ আরও বেড়ে যায়।

মনে করি একটা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। সেখানে সয়েল কন্ডিশন ৩০ ফুটের নিচে খুব ভালো। কিন্তু রিপোর্টে দেখানো হল ৮০ ফুট পাইলিং লাগবে। কন্ট্রাক্টর কাজ করার সময় পাইলিংয়ের বিল নেবে ৩০ বা ৩৫ ফুটের বাকীটা যাবে উনাদের পকেটে। এমন অনেক কথা বলা যায়। সুযোগ আর জীবনের নিরাপত্তা পেলে অনেকেই অনেক কথা বলে দেবেন।

প্রকল্পের গাড়ি নিয়ে যে তুঘলকি হয় তাঁর বর্ণনা দিতে আরেকটা লেখা দাঁড় করাতে হবে। সেখানে শুধু চুরি না ডাকাতির মাধ্যমে সরকারী সম্পত্তি লুটেপুটে খাওয়া হয়।

প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় মানহীন উপাদান বা প্রযুক্তি দিয়ে। তাই সেটা কখনো তৈরির সময় কখনো বা তৈরি ২/৩ বছর পরেও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এর দায় বাস্তবায়নকারী সরকারী কর্মকর্তা আর ঠিকাদার উভয়কেই নিতে হবে তার জন্য প্রয়োজনে আইন করে তার আশু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি কোন দপ্তর বা হাসপাতালে গিয়ে বাথরুম, সিঁড়ি, বারান্দা কথা ঠিকমত দাঁড়াতে পারবেন না। অধিকাংশ দরোজা জানালা, কিংবা অফিসের যন্ত্রপাতির অবস্থা এতোই করুণ যে তা না দেখলে বুঝা যাবে না। কোটি কোটি টাকার রক্ষণাবেক্ষণের টাকার আংশিক ব্যবহার হলেও রেল লাইনে বাঁশের ব্যবহার করা লাগতো না।

দেশপ্রেমিক মানুষ দিয়ে টাস্কফোর্স না গঠন করলে বাংলাদেশে পাকিস্তানের আদলে আমলা রাষ্ট্রে পরিণত হবে, সেখানে রাজনীতিকগন হবে আমলাদের তল্পিবাহক মাত্র। কারণ এখনই লাগাম টানা না গেলে অসৎ ব্যবসায়ী আর অসৎ আমলারা আর্থিক আর আইনি শক্তিতে হবেন অপ্রতিরোধ্য একদল দৈত্য দানবের মত যাতে দুর্নীতি করে সহজে কেউ পার না পায়। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে, দুর্নীতি তাঁর চরম ত্যাগ আর অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। তাই কোনোভাবেই দুর্নীতি তথা দুর্নীতিবাজদের সাথে আপোষ নয়।

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭