ইনসাইড আর্টিকেল

এতো খুন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিচার হয়না কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 09/10/2019


Thumbnail

আমাদের সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া জ্ঞান অর্জনের দ্বিতীয় ভালো কোনো অপশন নেই বলে মনে করা হয়। মানে সর্বাধুনিক, মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিকল্প নেই। যে শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত, তাকে আমরা দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বলি। হ্যাঁ, প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। কারণ এখানে পড়াশুনার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয়, এখানে এসে মানুষ সুনাগরিক হওয়ার ঠিকানা খুঁজে পায়। আর তাই বেড়ে উঠতে উঠতে প্রতিটি ছেলেমেয়েকে শেখানো হয় যে তোমাকে নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ভালো সাবজেক্টটিতে পড়তে হবে।

শিক্ষাব্যবস্থা যাই হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে মৃত্যুখনিও হয়, সেটা যে কতটা ভয়, আতঙ্ক আর লজ্জার- সেটা বলতে গেলে কেমন কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। অভিভাবকরা এক বুক স্বপ্ন আর আস্থা নিয়ে আর কীভাবে তার প্রাণের সন্তানকে দেশসেরা বিদ্যাপিঠগুলোতে পাঠাবে? আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এই প্রশ্নটিই বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করছে সবাইকে।

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত যত খুন হয়েছে, তার যথার্থ বিচার হয়নি আজও। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে যোগ করলে দেখা যায়, গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে মারা গেছেন ২৪ জন।

এই ২৪ জনের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ জন, রাজশাহীতে ৫ জন, ময়মনসিংহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও ৩ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ১৭টি ঘটেছে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। কিন্তু বিচার হয়নি আজও। কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আজ পর্যন্ত হয়নি বলেই এই হত্যাকাণ্ডগুলো থামছে না।

এই খুনগুলোর বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। অস্থির এবং বেপরোয়া ছাত্ররাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিউদ্দিন কায়সারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির রাতে। এখানেও ছিল রাজনৈতিক কোন্দল। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে শাহ আমানত হল ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন নিহত হন। ২০১০ সালের ২৮ মার্চ রাতে শাটল ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহর হতে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে চবি মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশীদকে গলাকেটে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১৫ এপ্রিল ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে অ্যাকাউন্টিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আসাদুজ্জামান নিহত হন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালে ছাত্রলীগের দুইগ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ছাত্রলীগ কর্মী তাপস।

এরপর ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুজন এবং ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি একজন ছাত্রশিবির নেতা নিহত হন। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর নিজ বাসায় খুন হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী।

তাপস হত্যা মামলার আসামিরা কেউ জামিনে, কেউ পলাতক। মহিউদ্দিন মাসুম ও হারুনুর রশিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তখন ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এরপর এ ঘটনার অগ্রগতি হয়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবির-ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ কর্মী ও গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন। পরদিন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম শিবিরের ৩৫ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও অনেক শিবির নেতাকর্মীসহ ১০৭ জনকে আসামি করে মতিহার থানায় মামলা করেন। ২০১২ সালের ৩০ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। আসামিদের মধ্যে ৬০ জন এখন জামিনে।

একই বছর ১৫ আগস্ট শোক দিবসে টোকেন ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে শাহ মখদুম হলের দোতলার ছাদ থেকে ছাত্রলীগ কর্মী নাসিরুল্লাহ নাসিমকে ফেলে হত্যা করে ছাত্রলীগ সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা।

২০১২ সালের ১৫ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল। তার হত্যা মামলায় ১৪ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটির বিচার চলছে।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান মতিহার থানায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি আশরাফুল আলমসহ চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তবে প্রমাণের অভাবে মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে।

সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোন্দলে তিনটি হত্যার কোনোটিরই বিচার হয়নি। তদন্ত চলছে। এখনো খুনি শনাক্ত সম্ভবও হয়নি। আর বিচার চলমান একটি হত্যা মামলা আপস নিষ্পত্তির চেষ্টারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুটিপক্ষের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুইগ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে মারা যান সুমন চন্দ্র দাস। গুলির ঘটনায় তৃতীয়পক্ষ জড়িত কি না, এ বিষয়টি বের করার চেষ্টায় তদন্তে দেরি হচ্ছে।

২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর লিডিং ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মী ওমর মিয়াদকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরীকে আসামি করে মামলা হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্কলহের জেরে এক হামলায় গুরুতর আহত হন জাবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। পরদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মামলা হয়েছিল, বিচার হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্মমভাবে খুন হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর। এ হত্যা মামলায় সব আসামি ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১২ সালের ৯ জুন সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি ফাহিম মাহফুজ বিপুল।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন হাবিপ্রবির বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জাকারিয়া ও কৃষি বিভাগের ছাত্র মাহমুদুল হাসান মিল্টন। মামলা হয়েছে দুটি হত্যাকাণ্ডেরই। কিন্তু আসামিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আসেনি।

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭