ইনসাইড আর্টিকেল

বিচ্ছেদের পরে: পর্ব-২

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 10/10/2019


Thumbnail

‘এইতো সেদিন অফিসের এক জুনিয়র স্টাফকে দিয়ে আমার নামে একটি ফেসবুক আইডি খুললাম। ৪১ বছর বয়সে আমার প্রথম ফেসবুক প্রোফাইল। সচরাচর আপনারা ফেসবুক যে কারণে ব্যবহার করে থাকেন, সেজন্য নয়। আমার কারণটা একটু আলাদা, অনেকটা ভিন্ন। আমার একমাত্র ছেলে তনয়কে এক নজর দেখার জন্য এই আইডি খুলেছি। সে কীভাবে বড় হচ্ছে, কাদের সাথে মিশছে, কোন রঙের শার্টে কেমন মানায়, সানগ্লাসে কেমন হিরো দেখতে লাগে, তার কয়টা মেয়ে ফ্রেন্ড আছে...ইত্যাদি জানার আগ্রহেই এই বুড়ো বয়সে একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করেছি আর কি। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা তো সবকিছুর আপডেটই ফেসবুকে দেয়, তনয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছুনা। তাই আমিও দূর থেকে তাকে দেখতে পারছি।’ বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাজমা বেগম।

ভাবছেন, নিজের ছেলের বেড়ে উঠা দেখার জন্য মায়ের ফেসবুক আইডি খোলার কি প্রয়োজন রয়েছে? ছেলে কি বিদেশ থাকে? না, ছেলে বিদেশ থাকেনা। দেশেই থাকে, কিন্তু মায়ের থেকে দূরে থাকে, বাবার কাছে। প্রায় এগারো বছর আগে নাজমা বেগমের সাথে তার স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তখন থেকে তনয় বাবার সাথে থাকা শুরু করে। মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগই রাখেনি। নাজমা বেগম তার ছেলেকে এরপর থেকে সামনাসামনি আর কখনো দেখতে পায়নি।

“ইন্টারনেট বলেন কিংবা টেকনিক্যাল বিষয় বলেন, এসব ব্যবহারে আমি বরাবর খুব দুর্বল ছিলাম। তাই কলিগ যখন ফেসবুক আইডি খুলে দিলেন, সেটা বুঝে উঠতে বেশ কষ্টদায়ক হয়ে গিয়েছিলো। পরে আস্তে আস্তে খানিক বুঝে উঠতে পারলাম। এখন আমি নিজেই আমার ছেলের আইডি সার্চ করে তার ছবি দেখতে পারি।

তবে সমস্যা হলো অন্য জায়গাতে। এই আইডি খোলার জন্য নানাভাবে হ্যারেজের শিকার হচ্ছি আমি। ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে নানান সব নোংরা প্রস্তাব, লাগাতার মেসেজ। একদম বলতে পারেন বিরক্ত হয়ে কাহিল হয়ে পড়ি আমি। তার উপরে আমার অফিসের কলিগদেরও কোণাগাসা এই নিয়ে যে, আমি হঠাত করে কেন ফেসবুক প্রোফাইল খুললাম, নিশ্চয় এই বয়সে সঙ্গী খুঁজছি। আমি বুঝতে পারিনা, সঙ্গীর যদি প্রয়োজনও থাকে তার জন্য ফেসবুকই থাকতে হবে এমন কি কথা রয়েছে? “ বললেন নাজমা।

তাদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছিলো, আর ডিভোর্সের কি কারণ ছিল সে প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করায়, বেশ অনেকটা সময় নিয়ে তিনি জানান, “আমাদের বিয়েটা পারিবারিক পছন্দে হয়েছে। কিন্তু পরিবার থেকে আমাদের এক মাস সময় দিয়েছিলো নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর জন্য। আমার উনাকে বেশ ভালোই লেগেছিলো। খুব নরম স্বভাবের ছিলেন, আর খুব দায়িত্ববান ছিল। এই বিষয়টা আমার মন ছুয়েছিলো বেশ। আমাদের বিয়ের পরে সবকিছু খুব সুন্দর করেই চলছিলো। বিয়ের আগে প্রেম করতে না পারলেও বিয়ের পরে আমাদের প্রেম বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। অনেকটা হিংসে ধরিয়ে দেয়ার মতো। কিন্তু এই প্রেমের দৌড় খুব বেশী দূর পর্যন্ত ছিলোনা। হঠাত অতি চেনা একটা লোক আমার এতোটা অপরিচিত হয়ে উঠলো যা বলার মতোনা। আমার প্রতি তো বটেই, সংসারের প্রতিও উদাসীন হয়ে উঠেছিলো দিনকে দিন। প্রথম দিকে অনেক বুঝিয়েছি, কখনো রাগ করেছি, কিন্তু আশ্চর্য্য এই যে, সে কোনো উত্তরই দিতোনা। রাগের পরিবর্তে রাগও করতোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে বলে এড়িয়ে যেতো।  এভাবে দেখতে দেখতে বছরো কেটে গেলো, এর মধ্যে আমাদের মাঝে আসে আমাদের ছেলে তনয়। তখনো তিনি উদাসীন। তখন আর মানতে পারলাম না। দিনে একাধিকবার ঝগড়া হতো আমাদের।

একবারের একটা ঘটনা আপনাকে বলি, তাহলে বুঝতে পারবেন সমস্যা আসলে কোথায় ছিল। আমাদের ছেলের পঞ্চম জন্মদিন। ছেলে আগেরদিন বায়না ধরেছে জন্মদিনের দিন আমাদের দুজনকেই ছুটি নিতে হবে অন্তত তিনদিনের জন্য। আর পুরো সময় তাকে দিতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম, ওর বাবা প্রথমে রাজি না হলেও  পরে আমি জোরাজুরি করে রাজি করালাম।

কিন্তু সমস্যা হলো, জন্মদিনের আগের দিন অফিসের জরুরি মিটিং আছে বলে বেরিয়ে পড়লেন। পরের সাতদিনেও ফিরলেন না। এরমধ্যে কোনো যোগাযোগও করলেন না। ছেলেকে আনন্দে রাখার জন্য আমি একাই তাকে নিয়ে এদিক সেদিক বেরিয়ে আসলাম। লোকটা সাতদিন পর বাসায় ফিরেছে, তার রাত তিনটায়। আমার রাগ তখন চরমে। ঘরে ঢুকতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে চিল্লাচিল্লি শুরু করি। তিনি চুপ করে শুধু শুনলেন, হঠাত এগিয়ে এসে আমার চুলের মুঠি ধরে মারতে লাগলেন। মুখ থেকে মদের বিশ্রি গন্ধ। বিশ্বাস করুন, আমি সেদিন প্রথম জানলাম, তিনি মদ খান।

মার খেয়ে আমি তখন ফ্লোরে পড়ে আছি। কানের পাশ দিয়ে শোশো আওয়াজ হচ্ছে। তিনি রুমের দরজা লক করে বেরিয়ে গেলেন।

সংসারে প্রতি উদাসীন, আমার প্রতি উদাসীন সব ঠিক ছিলো, কিন্তু গায়ে হাত তোলাটা আমি কোনোভাবেই নিতে পারিনি। তাই চটপট সিদ্ধান্ত নিই ডিভোর্সের। আমার ভরণ পোষণ, ছেলের ভরণ পোষণ, দেনমোহরের টাকা কোনো কিছু চাইনি আমি। শুধু মুক্তি চেয়েছিলাম আমি। ভদ্রলোক, খুব অনায়াসেই তাতে রাজি হলেন। ফোনে খুব শান্ত স্বরে আমার সাথে শেষ একবার দেখা করতে চাইলেন। আমি অনেক ভেবে শেষে রাজি হলাম দেখা করতে।

সাক্ষাতের পর আমি যা জানলাম, তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি। আমাদের বিয়ের এক বছরের মাথায় তার আরেকজনের সাথে এফেয়ার হয়। সে কিভাবে যেন সে সম্পর্কে খুব গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। তাঁদের একটি বেবিও হয়। একসাথে দুটো পরিবারকে সময় দিয়ে তিনি পেরে উঠছিলেন না। তাই এমন আপত্তিকর সব ঘটনা ঘটেই চলছিলো।

আমি ভাবছিলাম, অন্তত লোকটা তার ভুল বুঝতে পেরেছে তাতেই বেশ। হঠাত, কঠোর গলায় তিনি বললেন, আর শোনো, তুমি ডিভোর্স চাচ্ছো, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু আমার ছেলে আমার কাছেই থাকবে, আর তুমি তার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবেনা। আমি এর প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত, আদালতে আমি হেরে যাই। কিন্তু তাও আশা ছিল, ছেলেকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কার কাছে থাকতে চাও, সে উত্তর দিল, আই হেট ইউ।

আমি আজ অব্দি জানিনা, অই লোকটি  আমার ছেলেকে আমার ব্যাপারে আসলে কি জানিয়েছিলো, যার জন্য আমার ছেলে কোনোদিন আমার কোনো খোঁজ রাখেনি।

বাংলা ইনসাইডার



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭